বি.এ পাশ করার পর ছকড়ি মুজমদার শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন এবং ১৯১৭ সালেই মানভূমের পাণ্ড্র রাজ হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার ছাপ ছিল তার চলনে ও কথা-বর্তায়। একজন আর্দশ শিক্ষক হিসেবে যে যে গুণ থাকা প্রয়োজন, তার প্রায় সবই ছিল তাঁর মধ্যে।
শিক্ষক নামটা শুনলেই যেন বিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। শিক্ষা আদান ও প্রদানের একটি পরিচিত মাধ্যম হল বিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মানুষের মতো মানুষ করে তোলেন তাঁরা। শিক্ষক নিজ পাঠদানের মাধ্যমেই বৃহত্তর পড়ুয়া সমাজে পরিচিত লাভ করেন। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম, শেখানোর নিরলস প্রচেষ্টা, শাসন সব দিক থেকেই শিক্ষক নামক বিশেষ চরিত্রটি স্থায়ী জায়গা করে নেয় ছাত্রছাত্রীদের মানসে।
এমন কিছু শিক্ষক ছিলেন, যাদের শিক্ষণ প্রণালী আজকের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। সেইসব শিক্ষকের কথা আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে। আজ যে শিক্ষকের কথা বলা হচ্ছে, তিনি ছকড়ি মুজমদার। বীরভূম জেলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক। অবিনাশপুরের বিদ্যালয় শিক্ষক থাকাকালীন তিনি এই পুরস্কার পান।
ছকড়ি মুজমদার ১৮৯৬ সালে বীরভূম জেলার আমোদপুরের নিকটবর্তী সাঙ্গুলডিহি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হরিদাস মুজমদার ও মাতা ছিলেন চন্দ মুজমদার। যদিও খুব ছেলেবেলায় বাবা-মাকে হারান তিনি। ছকড়ি মুজমদা রা ছিলেন চার ভাই।
ছোট থেকেই তিনি মেধাবী ছিলেন। ১৯০৬ সালে তিনি প্রাথমিকে বৃত্তিসহ পাশ করেন। এরপর ১৯০৯ সালে ইংরেজি বিভাগে বৃত্তি পান। এরপর তিনি অধুনা ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলার চাঁইবাসা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। বীরভূম এর হেতমপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন ও কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে ডিসটিঙ্কসন সহ বি.এ পাশ করেন ১৯১৭ সালে।
বি.এ পাশ করার পর ছকড়ি মুজমদার শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন এবং ১৯১৭ সালেই মানভূমের পাণ্ড্র রাজ হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার ছাপ ছিল তার চলনে ও কথা-বর্তায়। একজন আর্দশ শিক্ষক হিসেবে যে যে গুণ থাকা প্রয়োজন, তার প্রায় সবই ছিল তাঁর মধ্যে। রাজ হাইস্কুলে দু-বছর শিক্ষকাতা করার পর তিনি জামশেদপুরের পেরিন মেমোরিয়াল হাইস্কুলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ইংরেজি ভাষা ছাড়াও হিন্দি, সংস্কৃত, বাংলা, আরবি, অঙ্কতেও ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য।
এই জামশেদপুরে শিক্ষকতাকালীন বীরভূম এর অবিনাশপুরের জমিদার তথা রায়বাহাদুর অবিনাশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের নজরে আসেন তিনি। এখানে বলে রাখা ভাল, অবিনাশপুরের তখন নাম ছিল সুলতানপুর। সুলতানপুরকে আর্দশ গ্রাম হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন জমিদার অবিনাশবাবু। তাই গ্রাম পরিকল্পনার অন্যতম অঙ্গ ছিল শিক্ষাব্যবস্থা। নিজের প্রতিষ্ঠিত শ্রীরাম উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি আনলেন ছকড়ি মুজমদার কে। ১৯২৭ সালে শ্রীরাম উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর রায়বাহাদুরের পরামর্শ মতো বিদ্যালয়কে গড়ে তুললেন নিজের মতো করে।
পড়াশোনাকে শুধুমাত্র বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে বহুমাত্রিক করে তোলেন তিনি। তিনি ছিলেন মিষ্টভাষী ও সদালাপী। মাঝারি উচ্চতা ও শীর্ণদেহী ছিলেন। বিনয়ী, মৃদুভাষী অথচ তেজদীপ্ত ছিলেন। সবসবময় তিনি সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি পড়তেন। শ্রেণীকক্ষে প্রবেশের সময় তাঁর হাতে থাকত একটি ছোট বেত। তার জ্ঞানের পরিধি এতটাই বিশাল ছিল, যে বই না দেখেও তিনি পড়াতে অভ্যস্ত ছিলেন। কোনওদিন সংষ্কৃত বা আরবী ভাষার মৌলবী সাহেব বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি থাকলে ক্লাস যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য তিনি নিজেই সংস্কৃত ও আরবি ভাষার ক্লাস নিতেন। এই দুই ভাষার ওপর তার বুৎপুত্তি ছিল অসাধারণ। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অবাধ বিচরণ ছিল এবং প্রত্যেক বিষয়ে ছিল সুগভীর পাণ্ডিত্য। এইজন্য বিদ্যালয়ের অনেকেই তাঁকে আচার্য্য বলতেন।
প্রধান শিক্ষক হিসাবে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার খোঁজখবরও রাখতে হত। তখন অবিনাশপুরের এই স্কুলে তিনটি ছাত্রাবাস ছিল। ছাত্রদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০-এর কাছাকাছি। বিদ্যালয় ছুটির পর ছাত্ররা ঠিকঠাক নিজেদের হোস্টলে পৌঁছেছে কিনা সেটারও তাদারিক করতেন তিনি। তাছাড়া ছাত্ররা হোস্টলে পড়াশোনা করছে কিনা ও খাবার ঠিকঠাক পাচ্ছে কিনা তার খোঁজ নিতেন তিনি। সকাল সাতটা থেকে শুরু করে রাত্রি দশটা পর্যন্ত বিদ্যালয়েই থাকতে হত ছকড়ি মুজমদার কে। মাঝে সংক্ষিপ্ত সময়ে বাড়ি গিয়ে স্নান ও আহার সেরে বিদ্যালয় আসতেন। বিদ্যালয় ও তার ছাত্ররাই ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।
পল্লীগ্রামের আর্দশ বিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য ছাত্রদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মমুখী ও ব্যবহারিক শিক্ষাচর্চার পাঠকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট ছিলেন ছকড়ি মুজমদার। যেমন তাঁতবোনা, লোহার কাজ, কাঠের কাজ ও কৃষিকাজ। সেইসময় পল্লীগ্রামের কোনও বিদ্যালয়ে এই সমস্ত ব্যবহারিক শিক্ষার দেখা পাওয়া ছিল দুঃষ্কর। শুধু তাই নয় বিট্রিশ শাসনকালে বীরভূমের একমাত্র বিদ্যালয় হিসাবে অবিনাশপুর শ্রীরাম উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রচলন ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার এমন গাঢ় সন্নিবেশ সেইসময় শুধু বীরভূমে নয়, গোটা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণের নজির সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। বঙ্গের প্রদেশপাল জন আন্ডারসন, শ্রীনিকেতনের কর্মী লেনার্ড এলমহাস্ট, শিক্ষা সচিব ই.এফ.ওটেন সবাই তা একবাক্যে স্বীকার করেছেন।
এতসব বৃত্তি শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্রদের শারীরশিক্ষার দিকেও লক্ষ্য রাখা হত, যাতে তাদের মানসিক বিকাশ ও দেহচর্চা ঠিক থাকে। তৎকালীন সময়ে বীরভূম জেলার ম্যাজিস্ট্রেট গুরুসদয় দত্ত বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। ছকড়ি মজুমদার শিক্ষকতার পাশাপাশি বিদ্যালয়টিকে পল্লীর একটি আর্দশ বিদ্যালয়ে রূপদান সংকল্প হয়েছেন তা দেখে মুগ্ধ হন। গুরুসদয় দত্ত বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির সভাপতি নিযুক্ত হন। সহকারী প্রধান শিক্ষক নবনীধর মন্ডলকে সঙ্গে নিয়ে অবিনাশপুর উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গড়ে তোলেন ব্রতচারী দল। আজকের ব্রতচারী আন্দোলনের জন্মভূমি ছিল এই অবিনাশপুর বিদ্যালয়। অবিনাশপুর হয়ে উঠল ব্রতীধাম। ছকড়ি মুজমদার দুঃস্থ ছাত্রদের আর্থিক সাহায্যে করার জন্য করেছিলেন জুনিয়র রেডক্রস তহবিল। এখান থেকে দুঃস্থ ছাত্রদের সাহায্যে করা হত।
১৯৬১ সালে একবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভার শিক্ষাসচিব বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। বিশ্বভারতীর প্রধান শরৎ দত্তের কাছে অবিনাশপুরের এই বিদ্যালয়টির কথা জানতে পারেন। শান্তিনিকেতনের অদূরে পল্লী গ্রামে এইরকম বিদ্যালয়ের বিবরণ শুনে তিনি যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে লক্ষ্য করেন ছাত্ররা পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁতের গামছা বুনছে, কাঁসার বাসন বানাচ্ছে, সাবান তৈরি করছে, জৈব উপায়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, বিট, আলু ইত্যাদি ফসল ফলিয়েছে এবং যত্ন নিচ্ছে নিয়মিত। প্রধান শিক্ষক ছকড়ি মুজমদার মাটির ঘর ও খড় দিয়ে ছওয়ানো ঘরে বসে আছেন। পরিদর্শক দল ছকড়ি মুজমদারকে দেখে ও পরিকল্পনা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল।
ছকড়ি মুজমদারের অক্লান্ত পরিশ্রমে পল্লীর উপযোগী বিদ্যালয় হিসেবে রূপ পেল। অবিনাশপুর গ্রামের জমিদার অবিনাশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে দেওয়া কথা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। এরপর ভারতের রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের হাত থেকে তিনি আর্দশ শিক্ষক হিসাবে পুরস্কার লাভ করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, স্বাধীনোত্তর ভারতে বীরভূম জেলার মধ্যে প্রথম রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন ছকড়ি মুজমদার। অবসর নেওয়া পর বিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে প্রতিবছর তাঁর জন্মদিন পালন করা হত তাঁকে সমগ্র অবিনাশপুর গ্রাম ঘুরিয়ে। সেদিন ছাত্ররা বিতর্ক সভা ও সাহিত্য সভার আয়োজন করত। অবসরের পরও নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসতেন তিনি ছাত্রদের খোঁজখবর রাখতেন। ১৯৭৩ সালে ২০ জুন তিনি পরলোক গমন করেন।
বর্তমান এই ডিজিটল সভ্যতায় হাজার হাজার শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ শ্রেষ্ঠত্বের গুণে আর্দশ শিক্ষকের পুরস্কার পাচ্ছেন এবং তৎক্ষনাৎ প্রচারের আলোতেও আসছেন। কিন্তু ছকড়ি মজুমদার এর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ার খবর সবার কাছে ঠিকঠাক পৌঁছায়নি সেদিন। আজও অবিনাশপুরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শ্রীরাম উচ্চ বিদ্যালয়। অবিনাশ বাবুর পরিকল্পনা ও ছকড়ি মজুমদার এর অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রতিটি গল্প অমর হয়ে বেঁচে থাকবে।
(তথ্যঋণ : অবিনাশপুর শ্রীরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষক সুনীল মুজমদার, অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য, অবিনাশপুর শ্রীরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মণিময় মুজমদার)