২০০০ সালের পর থেকে এই সিনেমা হলগুলোতে ভিড় হলকা হতে থাকে। সিনেমা হলের মালিকেরা বিভিন্ন কায়দায় দর্শক বাড়ানোর চেষ্টাও শুরু করে। এর আগে যেমন কলকাতায় মুক্তি পাওয়া সিনেমা বেশ কিছুদিন পর আমোদপুরে আনা হত, এখন থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমা র রিল কিনে আনা শুরু হল। প্রথম প্রথম দর্শক হলমুখী হতেও থাকল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সিনেমা হলগুলির সর্বনাশ ডেকে আনে বর্তমানের ইন্টারনেট সংযোগকারী মোবাইল।
বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হল সিনেমা, বাংলায় বলে চলচ্চিত্র। যদিও চলচ্চিত্র পরিভাষার কাছে সিনেমা শব্দটি জনমানসে প্রচলন বেশি।বর্তমানে প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই টিভি ও স্মার্ট ফোন সিনেমা দেখাকে অনেকটাই সহজলভ্য করে দিয়েছে। কিন্তু একটা সময় ছিল, মানুষ সিনেমা দেখার জন্য পুরোপুরিভাবে সিনেমা হল নির্ভর ছিল। তাই দু’দশক আগেও প্রতিটা মফস্বলে অন্তত একটি করে সিনেমা হল থাকতই।
এক সময় বীরভূম জেলার আমোদপুর শহরে সিনেমা হলের কদর ছিল খুব। আমোদপুরে সিনেমা এবং ভিডিও হল মিলিয়ে মোট চারটি সিনেমা হল ছিল। বর্তমানে এই চারটি সিনেমা হলের একটিরও অস্তিত্ব আর নেই। রয়েছে শুধু তার স্মৃতি।
যাইহোক, আমোদপুরে সিনেমা হলের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ১৯৫৯ সালে বর্তমানে ঈশ্বরপুর হাসপাতালের কাছে সাংড়ার রামবাবু “কমলা টকিজ” নামে তাঁবু খাটিয়ে একটি সিনেমা হল চালু করেছিলেন। প্রায় দু-বছর নিয়মিত সিনেমা চলার পর হঠাৎ করেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ সিনেমাটি কমলা টকিজ বহু দিন ধরেই চালিয়েছিল।
পরবর্তীতে ১৯৬২ সাল নাগাদ দুলুবাবু নামে এক ব্যক্তি “নিউ ওয়েস্টার্ন টকিজ” নিয়ে আসেন আমোদপুরে। এটিও ছিল কমলা টকিজের মতোই তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা হল। এই হলটি ছিল বর্তমানের আমোদপুর-লাভপুর সড়কের পাশে পেট্রোল পাম্পের উল্টো দিকে। তবে এই সিনেমা হলটি বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমোদপুরে আসত। দুলুবাবুর সিনেমা আসবে বলে তখন সাধারণ মানুষের উপচে পরা ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। কেউ কেউ পয়সা জমিয়ে রাখত সিনেমা দেখার জন্য। তৎকালীন বীরভূমে দুলুবাবুর সিনেমা হলের বেশ সুখ্যাতিও ছিল। আনুমানিক তিন বছর ওয়েস্টার্ন টকিজ চলার পর হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর আমোদপুরের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েক বছর তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা হল চলেছিল। ১৯৭৪-৭৫ সালে “জয়দুর্গা” সিনেমা হল তার যাত্রা শুরু করে। এটিই ছিল আমোদপুরের প্রথম পার্মানেন্ট সিনেমা হল। প্রথমদিকে মাটির গাঁথনি দিয়ে সিনেমা হলটি তৈরি করা হয়েছিল। যতদূর তথ্য পাওয়া যায়, এখানকার প্রথম সিনেমা টি ছিল গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় ও ছবি বিশ্বাস অভিনীত ‘তৈলঙ্গস্বামী’। দর্শকদের আগ্রহে রোজ তিনটে করে শো হত এখানে। প্রথমদিকে টিকেটের মূল্য ছিল ২০ পয়সা মাটিতে, ৫০ পয়সা বেঞ্চে এবং ১ টাকা চেয়ারে। সিনেমা দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক আসত প্রায় রোজই। প্রায়ই প্রতিদিন ছিল হাউজফুল।
তথ্য বলছে, উত্তমকুমারের কোনও সিনেমা এলে প্রথমদিন থেকেই টিকিট কাটার লাইন পড়ে যেত জয়দুর্গা সিনেমা হলে। ট্রেন, সাইকেল, গোরুর গাড়ি, এমনকি হেঁটেও দূর-দূরান্ত থেকে এখানে সিনেমা দেখতে আসত মানুষেরা। নতুন কোনও সিনেমা এলে বিভিন্ন অঞ্চলে ঢেঁড়া পিটিয়েও প্রচার করা হত।
১৯৭৭ সালে ঈশ্বরপুরে অগ্রদূত ক্লাবের উদ্যোগে “অগ্রদূত” সিনেমা হল চালু হয়। সিনেমা হল চালু হবার পর এখানেও দর্শকদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। আট থকে আশি সবাই সিনেমা দেখতে আসত। ‘শ্রীশ্রী মালক্ষ্মী’ অগ্রদূত সিনেমা হলে চলা প্রথম সিনেমা। দর্শকদের উল্লেখযোগ্য ভিড় দেখে পরবর্তীকালে আমোদপুরে আরও অনেকগুলি ভিডিও হলও একে একে খুলতে শুরু করেছিল সেসময়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল “গৌরাঙ্গ” আর “লোকনাথ” হল। ১৯৯৩ সালে আমোদপুর স্টেশন সংলগ্ন ঘাটোয়াল পাড়ায় ছিল এই লোকনাথ হলটি।
তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুরই পরিবর্তন হতে শুরু করল। এই সময় বাড়িতে বাড়িতে এসে পৌঁছাতে লাগল টেলিভিশন বা দূরদর্শন। এখন থেকে ঘরে বসেই দেখে নেওয়া যাচ্ছে পছন্দের সিনেমাগুলি। তাই সিনেমা হলগুলিতে ক্রমশ ভাঁটা পড়তে শুরু করে। প্রথমদিকে দূরদর্শনে শুধুমাত্র রবিবারেই সিনেমা হত। তারপর কেবল লাইন সংযোগে বেশ কিছু বাংলা চ্যানেল দুপুরে ম্যাটিনি শো চালু করে। তাই পকেটের পয়সা খরচ না করে বাড়িতে বসেই সিনেমা দেখা শুরু হল। যদিও ভিড় একেবারে কমে না গেলেও আগের মত সিনেমা দেখার জৌলুস বা আবেগ আর ছিল না মানুষের।
তবে ২০০০ সালের পর থেকে এই সিনেমা হলগুলোতে ভিড় হলকা হতে থাকে। সিনেমা হলের মালিকেরা বিভিন্ন কায়দায় দর্শক বাড়ানোর চেষ্টাও শুরু করে। এর আগে যেমন কলকাতায় মুক্তি পাওয়া সিনেমা বেশ কিছুদিন পর আমোদপুরে আনা হত, এখন থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমা র রিল কিনে আনা শুরু হল। প্রথম প্রথম দর্শক হলমুখী হতেও থাকল।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে সিনেমা হলগুলির সর্বনাশ ডেকে আনে বর্তমানের ইন্টারনেট সংযোগকারী মোবাইল। আগের তুলনায় এই প্রযুক্তি অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে সিনেমা দেখাতে। মানুষ এখন আর সিনেমা হলমুখী হতে চায় না। যখন খুশি, যেভাবে খুশি নিজের পছন্দ মতো সিনেমা দেখতে পারছে বারবার।
আজ আমোদপুরে আর একটিও সিনেমা হল অবশিষ্ট নেই। সবগুলিই এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এক সময়ের জনপ্রিয় জয়দুর্গা সিনেমা হলটি এখন একটি শিশু বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। অগ্রদূত সিনেমা হলটি প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ ধ্বংসস্তূপ রূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু স্মৃতি কথায় আজও বেঁচে রয়েছে সিনেমা হলের অফুরন্ত গল্পগুলি।
তথ্যঋণ : করুণা চট্যোপাধ্যায়, হিমাংশু সরকার, নিমাই দে।