উইলিয়াম ওয়ার্ডের লেখার থেকে ১৮০১ সালের শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গা পুজো উপলক্ষে অনুষ্ঠিত অশ্লীল নাচের আসরের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র পাওয়া যায়। তিনি পুজো মণ্ডপে খিস্তি-খেউড় ও নানা প্রকার বেলেল্লাপনা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তবে ওয়ার্ড সমালোচনা করলেও অধিকাংশ সাহেবেরা বিষয়টি বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়েই উপভোগ করতেন।

১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পর থেকেই কোম্পানির সাহেব-সুবোরা বাঙালির দুর্গা পুজোর বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। আবার অপরপক্ষে ইংরেজদের সৃষ্ট বাংলার ‘বাবু’ সম্প্রদায়ও ইংরেজদের দাক্ষিণ্য লাভের জন্য দুর্গা পুজোয় ইংরেজ রাজ-পুরুষদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের যথোপযুক্ত মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতেন। বাস্তবিক দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে ইংরেজ ও ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পারিক সৌহার্দ্যের মেল বন্ধন সৃষ্টি করাই ছিল উভয়পক্ষের মূল উদ্দেশ্য। বলা যেতে পারে দুর্গা পুজোকে উভয়পক্ষেই কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত।
তাই ইংরেজ সাহেবরা যেমন গোড়া খৃষ্টান হয়েও বাবুদের দুর্গা পুজোয় অংশগ্রহণ করতেন, তেমনই রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের কুলপতি বাবুগণও দুর্গা পুজোয় বিধর্মী সাহেবদের অংশগ্রহণকে বিশেষ মর্যাদার বিষয় বলে মনে করতেন। এমনকি সাহেবদের খুশি করার জন্য কখনও কখনও দেবী দুর্গা -র মুখ ইংল্যান্ডেশ্বরীর আদলে গড়া হত। বাইনাচের আসর বসানো, মদ্যপানসহ নানা আমোদ-প্রমোদের এলাহি আয়োজন থাকত। এই সব ঘটনার কথা লিখে গিয়েছেন শ্রীরামপুরের মিশনারি রেভারেণ্ড উইলিয়াম ওয়ার্ড, ফ্যানি পার্কস, শিল্পী ফ্রান্সিস বলথেজার সলভিন্স, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রমুখ সমকালীন লেখকেরা।
উইলিয়াম ওয়ার্ডের লেখার থেকে ১৮০১ সালের শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গা পুজো উপলক্ষে অনুষ্ঠিত অশ্লীল নাচের আসরের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র পাওয়া যায়। তিনি পুজো মণ্ডপে খিস্তি-খেউড় ও নানা প্রকার বেলেল্লাপনা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তবে ওয়ার্ড সমালোচনা করলেও অধিকাংশ সাহেবেরা বিষয়টি বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়েই উপভোগ করতেন।
শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেববাহাদুর পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের বিষয়টিকে বিজয় উৎসব রূপে পালনের জন্য ১৭৫৭ সালে দুর্গা পুজোর সূচনা করেন। এই উপলক্ষে ক্লাইভের মনোরঞ্জনের জন্য যে নাচ-গানের আসর বসিয়েছিলেন, তাতে তৎকালীন সময়ে ১২ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। কোম্পানি আমলের এই ধারা পরবর্তীকালেও অব্যাহত থাকে। ১৮২৯ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর জাঁকজমক দেখে মুগ্ধ হন লর্ড ও লেডি বেন্টিঙ্ক।
লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান পাথুরিয়াঘাটার বাবু রামলোচন ঘোষ ১৭৮৪ সালে তাঁর বাড়িতে ঠাকুর দালান নির্মাণ করে তিনি দুর্গা পুজো শুরু করেন। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস এই পুজোতে সস্ত্রীক অংশগ্রহণ করতেন।
সাহেবরা যে শুধু পুজোয় উপস্থিত থেকেই তাদের কর্তব্য সারতেন এমনটা নয়। অনেকে পুজোয় পাঁঠা মানসিক থেকে শুরু করে ফল, মিষ্টান্ন ও দক্ষিণা সহযোগে পুজোয় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। এর মধ্যে কতটা ভণ্ডামি বা শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল তা বলা মুশকিল।
তবে ব্যতিক্রমী ছিলেন বর্তমান বীরভূম জেলার গুণুটিয়া ও সুরুলের কুঠির কুঠিয়াল জন চিপস্। চিপস্ সাহেব তাঁর সদাশয়তার জন্য বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি স্থানীয় জনসাধারণের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছিলেন। অন্যদের মতো অত্যাচারী কুঠিয়াল বলে তাঁর অখ্যাতি ছিল না। স্থানীয় জনসাধারণ চিপস্ সাহেবকে দেবতার মতো ভক্তি করত। লোকে চিপস্ সাহেবের কাছে তাদের নানা অভাব অভিযোগের কথা জানাত। জন চিপস্ও সাধ্য মতো তাদের সহায়তা করতেন। এইভাবে চিপস্ সাহেব ডিসট্রিক্ট কালেক্টরের চেয়েও বেশি ঠাটবাট নিয়ে চলতেন। এ নিয়ে অবশ্য কালেক্টরের ক্ষোভের অন্তঃ ছিল না।
সে যাইহোক, চিপস্ সাহেব তখন ব্যক্তিগত ব্যবসা খুলেছেন। কিন্তু ব্যবসা তেমন জমছে না। এদিকে কোম্পানির অন্যসব কর্মচারী ব্যক্তিগত ব্যবসা খুলে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন। চিপস্ কি করা যায় যখন ভাবছেন, তখন তাঁর দেওয়ান রায়পুরের লর্ড সত্যপ্রসন্ন সিংহের পূর্ব পুরুষ শ্যামকিশোর তাঁকে পরামর্শ দিলেন, ‘ঘাবড়ানোর কি আছে সাহেব? তুমি এক কাজ করো, দুর্গোৎসব করো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মায়ের কৃপায় তোমার কোনও দুঃখ থাকবে না।’
শ্যামকিশোরের পরামর্শ শিরোধার্য করে চিপস্ সাহেব সুরুলের কুঠিতে মহাধূমধাম করে শুরু করলেন দুর্গা পুজো। সেই আমলে পুজোর সর্বমোট খরচ ছিল পঞ্চাশ টাকা। যা তখনকার সময়ে নিতান্ত কম টাকা নয়। চিপস্ সাহেব পুজোতে খরচ করতেন সতেরো টাকা। বাকি টাকায় গ্রামের লোকদের নতুন জামাকাপড় কিনে দিতেন। মহাষ্টমীর দিন সকলের জন্য রীতিমতো ভুরি ভোজের ব্যবস্থা করতেন।
কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উদযাপনের জন্য মহাধুমধামের সঙ্গে দুর্গা পুজো শুরু করেন। সেই পুজোতেও বাইনাচ ও খেঁউড়ের আসর বসত। বহু ইংরেজ উচ্চ পদস্থ রাজ-পুরুষ রাজার আমন্ত্রণে কৃষ্ণনগরে আসতেন। এবং সেইসব অশ্লীল আমোদ-প্রমোদ রীতিমতো উপভোগ করতেন।
এইভাবে সাহেবরা নেটিভদের পুজোতে নানাভাবে অংশগ্রহণ করতেন। এমনকি দুর্গা পুজোর সময় কোম্পানির ফৌজ দুর্গা প্রতিমাকে মার্চ করে এসে রীতিমতো সেলামি ঠুকত। পরবর্তীকালে অবশ্য এই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।