পুত্রের মৃত্যুর পর কউর দম্পতি সেই সংরক্ষিত শুক্রাণু ফিরে পেতে আবেদন করে গঙ্গারাম হাসপাতালের কাছে। তাঁদের আশা, ওই শুক্রাণু ব্যবহার করে ‘সারোগেসি’-র মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করবে তাঁদের নাতি বা নাতনি। যাদের সম্পূর্ণ দায়িত্বভারও গ্রহণ করবেন তাঁরা। সেই সন্তানের মধ্যেই বেঁচে থাকবে তাঁদের মৃত ছেলে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সংরক্ষিত সেই শুক্রাণু ফিরিয়ে দিতে রাজি ছিল না।

দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালের সঙ্গে প্রায় ৪ বছর আইনি লড়াই লড়ে আসছিলেন কউর দম্পতি। অবশেষে দিল্লি আদালতের নির্দেশে ফিরে পাওয়ার আশা দেখছেন তাঁদের মৃত পুত্রের সংরক্ষণ করে যাওয়া শুক্রাণু। যা তাঁদের ‘বংশের প্রদীপ’ ফিরিয়ে দেবে বলে আশা করছেন ওই দম্পতি।
আসলে কউর দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। তাঁদের ছেলে মাত্র ৩০ বছর বয়সে অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান। ফলে তাঁদের বংশ রক্ষায় আর কারোরই অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিতে বর্তমানে অসম্ভবও অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে। এই ধারণা থেকেই দীর্ঘ ৪ বছর আইনি লড়াই লড়ে যাচ্ছিলেন কউর দম্পতি। অবশেষে তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আদালত তাঁদের পক্ষেই রায় দিল সম্প্রতি।
বিবিসি সংবাদ মাধ্যমের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ৩০ বছর বয়সী অবিবাহিত যুবক প্রীত ইন্দর সিং ২০২০ সাল নাগাদ জানতে পারেন তিনি ‘নন হজকিংস লিম্ফোমা’ নামের একটি রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। ওই বছর জুন মাসে তিনি দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান। চিকিৎসা শুরুর পূর্বে তিনি জানতে পারেন, একবার কেমোথেরাপি শুরু হলে তাঁর শুক্রাণু –র গুণমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
পরে হাসপাতালের পরামর্শে প্রীত ইন্দর সিং কেমোথেরাপি শুরুর আগেই ২৭ জুন বরফ আকারে তাঁর শুক্রাণু জমিয়ে রাখেন। যা এতদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছেই সংরক্ষিত রয়েছে। এই সংরক্ষণের সম্পূর্ণ খরচ এতদিন বহন করে এসেছেন প্রীত ইন্দর সিং এর বাবা-মা গুরভিন্দর সিং ও হসবির কউর। পরে ওই বছর সেপ্টেম্বর নাগাদ মারা যান প্রীত ইন্দর সিং।
পুত্রের মৃত্যুর পর কউর দম্পতি সেই সংরক্ষিত শুক্রাণু ফিরে পেতে আবেদন করে গঙ্গারাম হাসপাতালের কাছে। তাঁদের আশা, ওই শুক্রাণু ব্যবহার করে ‘সারোগেসি’-র মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করবে তাঁদের নাতি বা নাতনি। যাদের সম্পূর্ণ দায়িত্বভারও গ্রহণ করবেন তাঁরা। সেই সন্তানের মধ্যেই বেঁচে থাকবে তাঁদের মৃত ছেলে।
কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সংরক্ষিত সেই শুক্রাণু ফিরিয়ে দিতে রাজি ছিল না। আদালতে পেশ করা তাদের দাবি অনুযায়ী, কোনও মৃত ব্যক্তির শুক্রাণু শুধুমাত্র তাঁর স্ত্রী বা স্বামীকে দিতে পারে তারা। তাদের বাবা-মাকে নয়। এছাড়াও ভারতীয় আইনে এমন কোনও নীতিমালা নেই, যেখানে অবিবাহিত কোনও মৃত ব্যক্তির শুক্রাণু তার বাবা-মা বা উত্তরাধিকারিকে দিতে বাধ্য থাকবে হাসপাতাল।
এ ব্যাপারে সরকার পক্ষের আইনজীবীও সহমত পোষণ করেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। সরকার পক্ষের আইনজীবীর দাবি ছিল, ২০২১ সালে ‘সারোগেসি’ সংক্রান্ত যে আইন হয়েছিল ভারতে, সেটি শুধুমাত্র ছিল বন্ধ্যা দম্পতিদের জন্য। অবিবাহিত বা সিঙ্গেল নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে ‘সারোগেসি’-র মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। এদিকে প্রীত ইন্দর সিং ছিলেন অবিবাহিত। তিনি জীবিত অবস্থায় তাঁর সংরক্ষিত শুক্রাণু মৃত্যুর পর ব্যবহার করার কোনও লিখিত বা মৌখিক অনুমতি দিয়ে যাননি।
কউর দম্পতির আইনজীবীর অবশ্য যুক্তি ছিল, ভারতে ‘সারোগেসি’ সংক্রান্ত আইন আনা হয়েছিল, যাতে বাণিজ্যিকভাবে এই পদ্ধতির অপব্যবহার না করা ও দম্পতিদের ব্যক্তিগত পরিসরকে ব্যবহার না করা হয় তার জন্য। এছাড়াও সংরক্ষণের ফর্মে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে আইভিএফ পদ্ধতিতে কাজে লাগানোর জন্যেই প্রীত ইন্দর সিং তাঁর শুক্রাণু সংরক্ষণ করেছিলেন। ফর্মে তাঁর বাবা-মায়ের মোবাইল নাম্বারও দেওয়া রয়েছে। অতএব তাঁর অবর্তমানে তাঁর বাবা-মা-ই তাঁর সংরক্ষিত শুক্রাণুর উত্তরাধিকারি।
অবশেষে দীর্ঘ চার বছর পর দিল্লি আদালত কউর দম্পতির পক্ষেই রায় দিয়েছে সম্প্রতি। আদালত জানিয়েছে, এটা স্পষ্ট হয়েছে যে প্রীত ইন্দর সিং তাঁর সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যই তাঁর শুক্রাণু সংরক্ষণ করেছিলেন। তাই তাঁর বাবা-মা অর্থাৎ কউর দম্পতির কাছেই তাঁর শুক্রাণু ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
কউর দম্পতি আদালতের এই রায়ে আশা দেখছেন বলে মনে করছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, দেরিতে হলেও আদালতের এই রায়ে তাঁরা তাঁদের নাতি-নাতনির মুখ দেখতে পারবেন। তাঁদের আরও দাবি, ‘সারোগেসি’ পদ্ধতিতে শুক্রাণু ব্যবহার করে সন্তান জন্ম দিতে তাঁদের এক মেয়ে অর্থাৎ প্রীত ইন্দর সিং-এর বোন রাজিও হয়েছেন।