অন্যান্য স্থানের দুর্গা পুজোর মতোই এই পরিবারের দুর্গা পুজোও সমস্ত নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে হয়ে থাকে। তবে কিছুক্ষেত্রে রয়েছে ব্যতিক্রম, যা অন্য দুর্গা পুজোর থেকে করে দিয়েছে সম্পূর্ণ পৃথক। এখানে অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় বাড়ির মেয়েরা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়। যাকে ‘ঠারগো’ নাম দেওয়া হয়েছে। অন্য কোথাও এই রীতি রয়েছে কিনা জানা যায় না।

শহরের থিমপুজো আর জাঁকজমক আলোকসজ্জার ভিড়ে গ্রাম-বাঙলায় যে কয়েকটি পারিবারিক তথা বনোদি পুজো আজও তাদের বংশপরম্পরায় ঐতিহ্য বহন করে চলেছে, তার অন্যতম বীরভূম জেলার ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের রামনগর গ্রামের সরখেল-মুখার্জী বাড়ির দুর্গা পুজো। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘সাজার বাড়ি’-র দুর্গা পুজো নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এবছর এই পুজো ২৯২ বছরে পদার্পণ করল।
এর আগে এই রামনগর গ্রামে ১৮টি দুর্গা পুজোর প্রচলন ছিল। তবে সময়ের বিবর্তনে ধাপে ধাপে পুজোর সংখ্যা কমে গিয়ে এখন মাত্র ৬টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন অবশ্য ‘পাঠশাল’ বাড়ির দুর্গা পুজো।
সরখেল-মুখার্জী বাড়ির দুর্গা পুজো বা ‘সাজার বাড়ি’-র দুর্গা পুজোর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, এই পুজো শুরু করেন সরখেল পরিবারের পূর্বপুরুষ জগন্নাথ সরখেল। তাঁদের আদি নিবাস ছিল মুর্শিদাবাদের টুনি নদীর তীরে বালিয়া গ্রামে। তখন বারংবার বর্গি আক্রমণে ত্রস্ত ছিল সমগ্র বাংলা। সম্ভবত চতুর্থ বর্গি আক্রমণের সময় বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ যখন অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত, এই সুযোগে বর্গিরা রঘুজী ভোঁসলের নেতৃত্বে বাংলার মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের দিকে অগ্রসর হলে জগন্নাথ সরখেল আতঙ্কিত হয়ে নারায়ণ শিলা ও দেবী দুর্গা -র খড় নিয়ে কোনও ক্রমে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালিয়ে আসেন বীরভূমের ময়ূরাক্ষী নদী তীরবর্তী এই বর্ধিষ্ণু রামনগর গ্রামে।
তখন এই গ্রামে ছিল বিত্তশালী রামজয় দত্তের একচ্ছত্র আধিপত্য। দত্ত-রা সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে রামনগরে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় জগন্নাথ সরখেলকে। প্রায় তখন থেকেই জগন্নাথ সরখেল রামনগরে শুরু করেন মাতৃ আরাধনা। আর সেই সঙ্গে চলে নারায়ণ শিলার পুজোও। জগন্নাথ সরখেলের পরে এই মাতৃ আরাধনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর বড় ছেলে কমললোচন সরখেল।
এখানে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সরখেলদের এই মাতৃ আরাধনার সঙ্গে মুখার্জীদের কি সম্পর্ক থাকতে পারে? আসলে জগন্নাথ সরখেলের বড় ছেলে কমললোচন সরখেলের মেয়ে ব্রজরানী-র সঙ্গে বিয়ে হয় ভ্রমরকোল গ্রামের রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়-এর। যিনি পরে ‘ঘরজামাই’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন রামনগরে। এবং এই বৈবাহিক সূত্রেই পরবর্তীকালে মাতৃ আরাধনার দায়িত্ব পায় মুখার্জী পরিবার। তখন থেকেই এই পুজো সরখেল-মুখার্জী বাড়ির দুর্গা পুজো নামে পরিচিতি পায়।
অন্যদিকে জগন্নাথ সরখেল-এর মেজ ছেলে রাজীব লোচন সরখেল সাজার বাড়ির পিছনে শুরু করেন আরও একটি দুর্গা পুজো, যেটি ‘মাইতো বাড়ি’-র দুর্গা পুজো নামে পরিচিত। যদিও এই পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুদিন আগেই। সেখানে পড়ে রয়েছে একটি ভগ্নপ্রায় দুর্গা দালান। এছাড়াও জগন্নাথ সরখেলের তৃতীয় পুত্র শ্যামলোচনও শুরু করেছিলেন আর একটি দুর্গা পুজো, যেটি ‘ল’ বা ‘সেজ’ বাড়ির দুর্গা পুজো নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু বছর ছ’য়েক আগে সেই পুজোটিও হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়।
‘সাজার বাড়ি’-র এই পুজোর প্রতিমা বরাবরই হয়ে থাকে একচালির। অন্যান্য স্থানের দুর্গা পুজোর মতোই এই পরিবারের দুর্গা পুজোও সমস্ত নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে হয়ে থাকে। তবে কিছুক্ষেত্রে রয়েছে ব্যতিক্রম, যা অন্য দুর্গা পুজোর থেকে করে দিয়েছে সম্পূর্ণ পৃথক। এখানে অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় বাড়ির মেয়েরা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়। যাকে ‘ঠারগো’ নাম দেওয়া হয়েছে। অন্য কোথাও এই রীতি রয়েছে কিনা জানা যায় না।
সরখেল পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্য ব্যোমশংকর সরখেল জানালেন, এখানে ঢাকের বদলে থাকে ঢোল, বাঁশি, কাঁসি। চতুর্থীর সন্ধ্যা থেকেই মন্দির চত্বরে বাজতে থাকে এই ঢোল। দশমীর দিন বিকালে এই বাড়ির প্রতিমা সহ গ্রামের আরও পাঁচটি বনেদি পরিবারের দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় মহাসমারোহে। যা এক শোভাযাত্রার সামিল। নিরঞ্জনের সময় ‘সাজার বাড়ি’-র এই প্রতিমাকে মন্দির থেকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাসস্ট্যান্ড (আগে যেখানে ছিল শশ্মান)-এ। এই পরিবারের বিশ্বাস অনুযায়ী সেখানে কিছুক্ষণ রাখা হয় পূর্বপুরুষদের দেখার উদ্দেশ্যে।
এই পরিবারের অন্য দুই সদস্য মঙ্গল সরখেল ও সুধাংশু সরখেল এর থেকে জানা গেল, গোটা বছর সরখেল ও মুখার্জী বাড়ির সদস্য-রা কর্মসূত্রে গ্রামের বাইরে থাকলেও পুজোর সময় প্রায় সকলেই হাজির হন গ্রামে। ২৯২ বছর পরও তাঁদের একান্ত প্রচেষ্টায় রামনগর গ্রামের ‘সাজার বাড়ি’-র এই দুর্গোৎসব আজও একই রকমভাবে জৌলুস ও আভিজাত্যে ভরে রয়েছে।