তিন পরিবারের মনোমালিন্য থেকেই মূলত এই তিন কালী -র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পরে অবশ্য এই মান-অভিমান মিটেও যায়। কিন্তু থেকে যায় প্রতিষ্ঠিত এই কালী তিনটি। আর প্রায় তখন থেকেই আলাদাভাবে পুজো না হয়ে একই মন্দিরে একই সঙ্গে পুজো পেতে থাকে এই তিন কালী প্রতিমার। তবে রীতি অনুযায়ী, তিন কালী -কে পুজো দেওয়ার জন্য এখনও নিয়োগ রয়েছেন পূর্ব নির্ধারিত তিন পুরোহিত।
সারা ভারতের মধ্যে বীরভূমই একমাত্র জেলা, যেখানে একই জেলায় ৫টি সতীপীঠ (কংকালীতলা, নলহাটি, লাভপুর, সাঁইথিয়া ও বক্রেশ্বর)-এর অস্তিত্ব রয়েছে। আর রয়েছে একটি সিদ্ধপীঠ বা শক্তিপীঠ (তারাপীঠ)। সেদিক থেকে দেখলে গোটা বীরভূম জেলাকেই পুণ্যভূমি বলা যেতে পারে। এর পাশাপাশি সমগ্র বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক কালী মন্দির ও বিগ্রহ। যার কোনও কোনওটি বেশ প্রাচীন। আবার কোনওটি খুব প্রাচীন নয়। আর এই মন্দির ও তার বিগ্রহের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানান লৌকিক ও অলৌকিক কাহিনি। যা স্থানীয় ইতিহাসকে অনেকটাই করে তুলেছে পরিপূর্ণ।
এই রকমই এক ঐতিহ্যময় কালী পুজোর সন্ধান পাওয়া যায় এই জেলার লাভপুর ব্লকের দোনাইপুর গ্রামে। দোনাইপুর এমনিতেই একটি বন্যা কবলিত গ্রাম। বর্ষায় পার্শ্ববর্তী কুঁয়ে নদীর জল ছাপিয়ে প্রতি বছর অফুরন্ত ক্ষতি হয় গ্রামটির। তবুও কালী -র মহিমা যেন গ্রামটির অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। দোনাইপুরের কালী পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এখানে একই মন্দিরে পুজো হয় তিনটি কালী প্রতিমার। যা বেশ বিরলই বলা চলে।
এই তিনটি কালী পুজোর সূচনা হয় যথাক্রমে উপেন্দ্রনাথ পাঠক, জমিদার অতুলশিব বন্দোপাধ্যায় ও মুখোপাধ্যায় পরিবারের হাত ধরে। উপেন্দ্রনাথ পাঠক এই গ্রামে কালী পুজোর সূচনা করেছিলেন প্রায় ১০০ বছর আগে। পরে বৈবাহিক সূত্রে এই পুজোর দায়িত্ব চলে যায় পাঠক পরিবারে জামাতা প্রয়াত কালীস্মরণ চক্রবর্তীর হাতে। উপেন্দ্রনাথ পাঠকের প্রতিষ্ঠিত এই কালী ‘টেবা মায়ের কালী’ নামে পরিচিত ছিল। অপরদিকে জমিদার অতুলশিব বন্দ্যোপাধ্যায়-এর প্রতিষ্ঠিত কালী পরিচিত ছিল ‘বড় মা’ নামে। এছাড়াও এই গ্রামের মুখোপাধ্যায় পরিবার যে কালী পুজোর সূচনা করেছিল, সেটি ‘বিশ্বেশ্বরী মা’ নামে পরিচিত ছিল।
গ্রামবাসী সূত্রে জানা যায়, তিন পরিবারের মনোমালিন্য থেকেই মূলত এই তিন কালী -র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পরে অবশ্য এই মান-অভিমান মিটেও যায়। কিন্তু থেকে যায় প্রতিষ্ঠিত এই কালী তিনটি। আর প্রায় তখন থেকেই আলাদাভাবে পুজো না হয়ে একই মন্দিরে একই সঙ্গে পুজো পেতে থাকে এই তিন কালী প্রতিমার। তবে রীতি অনুযায়ী, তিন কালী -কে পুজো দেওয়ার জন্য এখনও নিয়োগ রয়েছেন পূর্ব নির্ধারিত তিন পুরোহিত।
গ্রামবাসী সূত্রে আরও জানা যায়, এখানকার নাটমন্দিরটি নির্মিত হয়েছে বোলপুরের ব্যবসায়ী রামপ্রসাদ ঘোষের অর্থ সাহায্যে। দোনাইপুর গ্রামের বেনুকর বাগদী ও তরুণ দাস সূত্রে জানা যায়, গ্রামে দুর্গা পুজো হলেও কালী পুজোই যেন এই গ্রামের মূল উৎসব। পুজোর দিনগুলিতে সহস্রাধিক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এখানে। উৎসবের কথা মাথায় রেখে ছোট একটি মেলারও আয়োজন করা হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। সেই সঙ্গে চলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।