বীরভূম জেলার দুবরাজপুর ব্লকের সাহাপুর গ্রামের চক্রবর্তী পরিবারের কালী পুজো এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন ও জনপ্রিয়। এখানে কালী প্রতিমার উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। প্রাচীনত্বের নিরিখে এই পুজোর বয়স আনুমানিক ৫০০ বছরেরও বেশি। প্রাচীন এই পুজোর ইতিহাস নিয়ে স্থানীয়দের মুখে কয়েকটি কথা প্রচলিত রয়েছে। তাঁরা অনেকেই দেবীকে ‘চোরকাটা’ বলে অভিহিত করেন।
চক্রবর্তী পরিবারের সদস্য প্রলয় চক্রবর্তীও দাবি করেন তাঁদের কালী বা ‘বড় মা’ হল ‘চোরকাটা’। এই ‘চোরকাটা’ প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, একদিন তাঁদের ‘বড় মা’ ছোট বালিকার বেশে পাশ্ববর্তী তাপাসপুর জঙ্গল দিয়ে বিহার করে ফিরছিলেন। তার পরনে ছিল লাল পাড়ের শাড়ি ও গা ভরা গহনা। এমন সময় জঙ্গলে থাকা একদল ডাকাত বা দস্যু তার পথ আটকিয়ে গায়ের গহনা খুলে নিতে উদ্যত হয়। তখন ছোট্ট সেই বালিকা তার আসল রূপ বা দেবী কালী -র ভয়ঙ্করী রূপ ধরে ডাকাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আর ডাকাত দলকে একাই খড়গ হাতে বিনাশ করে। আর এই ঘটনার পরই মায়ের নাম হয়ে যায় ‘চোরকাটা’ মা বা দেবী।
গ্রামবাসী সূত্রে জানা গেল, যে স্থানে এমন ঘটনা ঘটেছিল সেখানে রয়েছে একটি পুকুর। ওই ঘটনার পর থেকে সেই পুকুরের জল আজও নাকি লালচে হয়ে রয়েছে। এবং ওই পুকুর নাকি কখনও শুষ্কও হয় না।
চক্রবর্তী পরিবারের ‘বড় মা’-কে এখানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে পুজো করা হয়। তবে ‘বড় মা’-র সাহাপুর গ্রামে আসার পিছনেও রয়েছে একটি ইতিহাস। শোনা যায়, ‘বড় মা’ পূর্বে পাশ্ববর্তী তাপাসপুর গ্রামের এক বটগাছের নিচে পলাশবাসিনি অষ্টভুজা রূপে বিরাজ করতেন। চক্রবর্তী পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষ ছিলেন মাতৃসাধক। কথিত রয়েছে, সেই সাধক সারা বছরই সেখানে যেতেন মায়ের সেবা করতে। একদিন অতিরিক্ত বর্ষায় নদীতে বান এলে সাধক সেবা করতে যাওয়ার মুহূর্তে আটকা পড়ে যান। তখন সাধকের আকুল মিনতি শুনে দেবী শৃগাল রূপে নদী পার হয়ে চলে আসেন এ পাড়ে।
এই ঘটনার পর দেবী পলাশবাসিনি স্বপ্নাদেশ দেন, তিনি এবার থেকে তাপাসপুরে নয়, সাধকের সেবা নিতে সাহাপুর গ্রামেই চলে আসবেন। তবে তার জন্য একটি পঞ্চমুণ্ডির আসন করতে হবে। ওখানে চতুর্ভূজা কালী রূপে তিনি অবস্থান করবেন। সেই থেকে এখানেই রয়েছেন ‘বড় মা’।
চক্রবর্তী পরিবার জানিয়েছে, এই পুজোয় ছাগ বলির প্রথা রয়েছে। প্রতিবার ৩০‐৪০টি ছাগ এখানে বলি দেওয়া হয়। এছাড়াও সাহাপুরের এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এখানে পরপর তিনটি মন্দিরে তিনটি আলাদা আলাদা শরিকের কালীপুজোর চল রয়েছে। এই তিনটি কালী -কে যথাক্রমে অভিহিত করা হয় ‘বড় মা’, ‘মেজো মা’ ও ‘ছোট মা’ নামে। ‘বড় মা’ এখানে ‘চোরকাটা’ নামে পরিচিত।
যেহেতু এটি পারিবারিক পুজো, তাই প্রতিমা মন্দিরেই গড়া হয় ও সাজিয়ে তোলা হয়। প্রতিমাতে রয়েছে সাবেকিআনার ছোঁয়া। লোকমুখে ‘জাগ্রত’ প্রচার হওয়ায় পুজোর দিনগুলিতে পাশ্ববর্তী গ্রাম তাপাসপুর, দেচাঁদরা, শুকদেবপুর, বাতিকার, রামচন্দ্রপুর সহ বহু দূর-দূরান্ত থেকে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে এখানে। কালী পুজোর রীতি অনুযায়ী, মা এখানে একদিনের জন্য থাকেন, পরের দিন তাকে বির্সজন দেওয়া হয়।