কলেজ জীবন থেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঝুঁকে পড়েছিলেন মার্কসবাদী রাজনীতির দিকে। বলতে গেলে তাঁর রাজনীতিতে সরাসরি অনুপ্রবেশ ঘটে ষাটের দশকে উত্তাল খাদ্য আন্দোলনের হাত ধরে। এই সময় পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন বাংলা বাম রাজনীতির অপর চার মূর্তি শ্যামল চক্রবর্তী, দীনেশ মজুমদার, বিমান বসু ও সুভাষ চক্রবর্তীকে।
বুদ্ধ যুগের অবসান ঘটেছিল অনেক আগেই। এতদিন শুধু পড়েছিল তাঁর ভগ্নপ্রায় শরীর। আর এবার সেই শরীরও তিনি তুলে দিতে এগিয়ে গেলেন এনআরএস-এর দরজায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর নেই। ৮ আগস্ট অর্থাৎ গতকাল সকাল ৮টা ২০ মিনিট নাগাদ পাম অ্যাভিনিউ-এর নিজের বাড়িতে তিনি প্রয়াত হন। আর সেই সঙ্গে এক বাম জামানার অবসান ঘটে গেল বঙ্গ রাজনীতিতে।
তখনও কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য জীবিত। লিখে চলেছেন একের পর এক কালজয়ী কবিতা। ঠিক এই সময়ে (১ মার্চ ১৯৪৪) উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে তাঁরই এক সম্পর্কিত ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্ম হল। সময়টা ব্রিটিশ যুগের একেবারে শেষ মুহূর্ত। আর কিছুদিন পরই স্বাধীন হবে দেশ। কিন্তু দেশ স্বাধীনের মাত্র ৩ মাস আগেই মারা গেলেন কবি সুকান্ত। তিনি জানতেও পারলেন না সেদিনের সেই জন্ম হওয়া শিশুপুত্রটি পরবর্তী সময়ে হবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। জানলে হয়তো ‘ছাড়পত্র’ কবিতাটি লেখার সার্থকতা তিনি নিজেই অনুভব করতে পারতেন।
যাইহোক, কবি সুকান্ত সাক্ষী থাকতে পারেননি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের শাসনামলের। কিন্তু সাক্ষী থেকেছে বর্তমান সময়ের আপামর জনসাধারণ। দীর্ঘ ১১ বছর বাংলাকে শাসন করে গিয়েছেন নিজের ‘শিল্প-নিপুণতায়’।
কলেজ জীবন থেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঝুঁকে পড়েছিলেন মার্কসবাদী রাজনীতির দিকে। বলতে গেলে তাঁর রাজনীতিতে সরাসরি অনুপ্রবেশ ঘটে ষাটের দশকে উত্তাল খাদ্য আন্দোলনের হাত ধরে। এই সময় পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন বাংলা বাম রাজনীতির অপর চার মূর্তি শ্যামল চক্রবর্তী, দীনেশ মজুমদার, বিমান বসু ও সুভাষ চক্রবর্তীকে। প্রমোদ দাশগুপ্তকে সামনে রেখে এগিয়ে গিয়েছে তাঁর রাজনৈতিক জীবন। সে সময় মাথার ওপর মহীরুহের মতো দাঁড়িয়েছিলেন জ্যোতি বসু। তাই রাজনীতি যেন অতি সহজ হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে।
১৯৭৭ সালে প্রথমবারের জন্য বিধানসভা নির্বাচনে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে বাম জামানার শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিদ্রাহীন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়েছিলেন একজন বলিষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে। ১৯৯৯ সালে প্রথমে উপ-মুখ্যমন্ত্রী, পরে ৬ নভেম্বর ২০০০ থেকে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
২০১১ সালই ছিল তাঁর শেষ নির্বাচন। ওই বছর ১৯ মে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম সরকারের ভরাডুবির মধ্য দিয়ে শেষ হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন। তিনি নিজেই যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা মণীশ পাণ্ডের কাছে পরাজিত হন। আর ফেরেননি রাজনীতিতে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বরাবরই বিশ্বাস করতেন রাজ্যের নতুন প্রজন্মের জন্য চাই শিল্প। এই বিশ্বাস থেকেই রাজ্যে আনতে চেয়েছিলেন টাটা গোষ্ঠীর ছোট গাড়ি শিল্পকে। কিন্তু একাধিক বাঁধার সম্মুখীন হয়ে তাঁর সেই আশা পূর্ণ হয়নি। ধরা যায়, এই বাঁধা তিনি আর কাটিয়েও উঠতে পারেননি। একাধিক রাজনীতিবিদের ধারণা, তাঁর ও তাঁর দলের মূল পতনের শুরু এখান থেকেই। যে পতন আর কোনওভাবেই রোধ করা যায়নি।
দীর্ঘদিন ধরেই তিনি শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এই সমস্যার জন্য তাঁকে একবার হাসপাতালে ভর্তিও হতে হয়। ২০২১ সালে আক্রান্ত হন কোভিডে। সেবারও তাঁকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। ২৯ জুলাই ২০২৩-এ আরও একবার তাঁর ঠিকানা হয় হাসপাতাল। ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে সংক্রমিত হয়ে দীর্ঘ ১২ দিন তাঁকে লড়তে হয়েছিল জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে।
সেবার সুস্থ হয়ে উঠলেও এবার আর তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। হেরে গেলেন মৃত্যুর কাছেই। গত ৮ আগস্ট সকালে প্রাতরাশের পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ৮টা ২০ মিনিট নাগাদ প্রয়াণ ঘটে তাঁর। ৯ আগস্ট বিকাল পৌনে ৬টা নাগাদ বিশাল জনস্রোতে ভাসিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নীলরতন সরকার (এনআরএস) হাসপাতালে। এখানেই তাঁর মরদেহ দান করা হবে।