গ্রামবাংলার ঝোপে-ঝাড়ে এক সময় বহ্নিশিখার দারুণ বাড়বাড়ন্ত ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে এখন বিলুপ্তির পথে এই বিষাক্ত ফুল গাছটি। পাঁচ পাপড়ি যুক্ত লাল ও হালকা হলুদের ছোঁয়া নিয়ে যখন ঝোপের মধ্যে অসংখ্য ফুল ফুটে থাকে, দেখতে অনেকটা অগ্নিশিখা বলে ভুল হতে পারে। গাছটি লতানো।

কথায় আছে, ‘যে কবিতা আর ফুল ভালবাসে না, সে মানুষও খুন করতে পারে’। কথাটা নেহাত ভুল নয়। কিন্তু হয়তো অনেকেই জানে না, ফুলও কিন্তু খুন করতে জানে। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, ব্যাপারটা একদম ঠিক। পরিবেশে জন্মানো অজস্র গাছ থেকে যেমন জীবনদায়ী ওষুধ তৈরি হয়, তেমনি অজস্র গাছ মৃত্যুর কারণও হয়ে উঠতে পারে।
তার মধ্যে কিছু সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারী ফুল গাছও রয়েছে। মজার ব্যাপার, না জেনে অনেকেই সেই সমস্ত বিষাক্ত গাছ বাড়ির অন্দরে সযত্নে পালন করে থাকেন। আর তার ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান। কিন্তু সামান্য অসাবধানতায় মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আজ এরকমই ৯টি বিষাক্ত ফুল –নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
৯. বেলাডোনা

বেলাডোনার আর এক নাম ‘সুন্দরী নারী’। শোনা যায়, মধ্যযুগে নারীদের চোখের মণি বড় ও আকর্ষণীয় করতে এক সময় এই ফুলের রস আইড্রপ হিসেবে ব্যবহার করা হত। হয়তো সেজন্যেই এমন নাম হয়েছে গাছটির। এই গাছ দেড় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ঘণ্টা আকৃতির ফুলগুলো বেগুনী, লাল, সাদা, গোলাপী রঙের হয়ে থাকে।
বেলাডোনা ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তৈরির জন্য এখন এর চাষও করা হচ্ছে। ফুলটিতে থাকা ট্রপেন এ্যালকলাইডিস নামে বিষের কারণে মাথাব্যথা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি প্রভৃতি সমস্যা তৈরি হয়।
৮. অটাম ক্রোকাস
অটাম ক্রোকাস ইউরোপের গাছ। এর আর এক নাম বা ‘নগ্ন নারী’। গাছের পাতাগুলো মরে যাওয়ার কিছুদিন পর সেখান থেকে ফুল ফোটে বলেই হয়তো এমন নাম রাখা হয়েছে গাছটির। সাধারণত শরৎকালেই এই গাছে ফুল ফুটতে দেখা যায়। রূপসী এই ফুলও কিন্তু দারুণ বিষাক্ত। যে বিষে প্রথমে শুরু হয় কাঁপুনি, তারপর রক্তচাপ হ্রাস। শেষে হৃদস্পন্দন থেমে মৃত্যু। যদিও ফুলটির কিছু উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি হয়।
৭. করবী
অতি পরিচিত করবী ফুলও কিন্তু কম বিষাক্ত নয়। এর ইংরেজী নাম অলিয়েন্ডার। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই বিষাক্ত ফুল গাছটি দেখা যায়। প্রজাতি ভেদে বিভিন্ন রঙেরও হয়ে থাকে এই ফুল। দেখতে সুন্দর হলেও গাছটির আপাদমস্তক মারাত্মক বিষাক্ত। এর মাত্র একটি পাতা খেলেই মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। দক্ষিণ ভারতের প্রচুর মানুষের আত্মহত্যার সঙ্গে এই ফুলটির নাম জড়িয়ে রয়েছে।
৬. রডোডেনড্রন

রডোডেনড্রন সাধারণত এশিয়া অঞ্চলের গাছ। এই গাছের ফুল আবার নেপালের জাতীয় ফুলেরও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। শীতের শেষ থেকে গ্রীষ্মের শেষ পর্যন্ত এই গাছে ফুল ফুটতে থাকে। ফুল বিষাক্ত না হলেও গাছের পাতা অকল্পনীয় রকম বিষাক্ত। পাতা মুখে দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মুখ পুড়ে যায়, লালা ঝরতে আরম্ভ করে। কিছু পরে বমি শুরু হয় এবং চূড়ান্ত বিপর্যয়ে ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। দ্রুত চিকিৎসা না করাতে পারলে রোগী কোমাতেও চলে যেতে পারে।
৫. ড্যাফোডিল

কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ এক সময় এই ফুলের প্রেমে পড়ে একটি কবিতাও লিখেছিলেন, ‘ড্যাফোডিল’। তাতে তার সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু হলুদ রঙের এই টিউলিপ জাতের ফুলও কিন্তু কম বিষাক্ত নয়। সুন্দর এ ফুলটির গোটা শরীরই বিষে পূর্ণ। পেটে যাওয়া মাত্রই প্রথমে ঝিমুনি, পরে পেটব্যাথা, বমি ও পাতলা পায়খানা শুরু হতে পারে। এমনকি সবশেষে পরিস্থিতি মৃত্যু পর্যন্তও গড়িয়ে যেতে পারে। সাধারণত উত্তর আমেরিকাতেই এই ফুল বেশি দেখা যায়। ছয় পাপড়ি যুক্ত ফুলটি সাধারণত হলুদ ও সাদা রঙের হয়ে থাকে।
৪. বহ্নিশিখা
গ্রামবাংলার ঝোপে-ঝাড়ে এক সময় বহ্নিশিখার দারুণ বাড়বাড়ন্ত ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে এখন বিলুপ্তির পথে এই বিষাক্ত ফুল গাছটি। পাঁচ পাপড়ি যুক্ত লাল ও হালকা হলুদের ছোঁয়া নিয়ে যখন ঝোপের মধ্যে অসংখ্য ফুল ফুটে থাকে, দেখতে অনেকটা অগ্নিশিখা বলে ভুল হতে পারে। গাছটি লতানো। তাই কোনও কিছুকে আঁকড়ে ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করে বহ্নিশিখা। দেখতে সুন্দর হলেও এর পুরো শরীর জুড়ে বিষ ছড়িয়ে রয়েছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা এক সময় শিকারে তীরের ফলায় এই গাছের রস মাখিয়ে নিত।
৩. ওয়াটার হেমলক

হেমলক একটি বিষের নাম। ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, দার্শনিক সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছিল হেমলক পানে। আর এই ফুলটির নামের সঙ্গেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে হেমলকের নাম, ওয়াটার হেমলক। এর আর এক নাম ইন্ডিয়ান একোনাইট।
ফুল দেখতে অনেকটা সাদা বা সবুজ ছাতার মতো। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার এই বিষাক্ত ফুল গাছ ভারতের শীতপ্রধান পাহাড়ি অঞ্চলেও জন্মাতে দেখা যায়। গাছটি এক মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
এর বিষ এতটাই মারাত্মক, পেটে যাওয়ার ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। প্রথমে পেটব্যথা, পরে বমি, শেষে প্রচণ্ড কাঁপুনি শুরু হয়। দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে এই ওয়াটার হেমলক ফুলটি। ফুলটিতে সিকোটক্সিন নামে এক ধরনের বিষ থাকে, যা মারাত্মক হৃদরোগের কারণ হতে পারে।
২. মঙ্কসহুড

মঙ্কসহুড কথার অর্থ সন্ন্যাসীর আচ্ছাদন। এটি এ্যাকোনিটাম জাতের গুল্ম। এর আরও বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে, উলফস বেইন, লেপার্ডস বেইন, মাউস বেইন, ওমেন্স বেইন, ডেভিলস হেলমেট, প্রভৃতি। অনেকেই ধারণা করেন, মঙ্কসহুড বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত ফুল গাছ। ফুল গাছটি ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। গাছটিতে ফোটা ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার লম্বা নীল রঙের ফুলগুলি অনেকটা হেলমেটের মতো দেখতে। হয়তো এজন্যেই এর আর এক নাম ডেভিলস হেলমেট।
গাছটি আগাগোড়া পুরোটাই বিষাক্ত। এর সান্নিধ্যে গেলেই বিষক্রিয়া শুরু হতে পারে। বিষ ছড়ায় ত্বকের মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে নার্ভ নিস্তেজ করে দেয়।
১. বিচ অ্যাপল
গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক গাছ’-এর তকমা দেওয়া হয়েছে বিচ অ্যাপল গাছটিকে। এর আরেক নাম ম্যাঞ্চিনেল। উত্তর আমেরিকার ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জে এই বিষাক্ত ফুল গাছের দেখা মেলে। গাছটির সম্পূর্ণ অংশ মারাত্মক বিষে ভরা। এই গাছের রস ত্বকের সংস্পর্শে ফোসকা সৃষ্টি করে। চোখে লাগলে যে কেউ অন্ধও হয়ে যেতে পারে। এমনকি জনশ্রুতি রয়েছে, বৃষ্টির সময় এই বিষাক্ত ফুল গাছের নিচে অবস্থান করাও নিরাপদ নয়। এক সময় শিকারিরা শিকারের সময় গাছের রস বিষ হিসেবে তীরের ফলায় ব্যবহার করত। তবে গোলাপী ও বেগুনী রঙের থোকা থোকা ফুলগুলি দেখতে যথেষ্ট সুন্দর।