বাংলাদেশ এ শেখ হাসিনা সরকারের সাম্প্রতিক পতনের পিছনের মূল কারণ নিয়েও রয়ে গিয়েছে একাধিক প্রশ্ন। যার অন্যতম, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের জন্যেই কি মূলত সরকারের পতন ঘটেছে? নাকি অন্য কোনও রহস্য রয়েছে লুকিয়ে?’ অন্তত আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক দাবির মধ্যে কোথাও উল্লেখ ছিল না, ‘দেশের সরকারের পতন ঘটাতে হবে’।
বাংলাদেশ এর ইতিহাসে ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলন অবশ্যই ‘উজ্জ্বল অক্ষরে’ লেখা থাকবে। কারণ, এই আন্দোলনই ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে সমগ্র পৃথিবীকে। ফেলে দিয়েছে এমন একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে, যে সরকার টানা পনেরো বছর বিপুল সংখ্যক গরিষ্ঠতা নিয়ে দেশ শাসন করে গিয়েছে। একবারের জন্যেও মাথা তুলতে দেয়নি বিরোধী কোনও দলকে। সরকারকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো কোনও রকম ক্ষমতা দেখাতে পারেনি কেউ। ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনকারীরা সেই ক্ষমতায় দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছে।
যাইহোক, খুবই কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ এ ঘটে গিয়েছে অনেকগুলি পরিবর্তন। দেশটি এখন ছাত্র সমাজ দ্বারা নির্বাচিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্তর্গত। সরকারকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ এর নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু প্রত্যেকটি বড় ঘটনার পিছনে থেকে যায় কিছু রহস্য, কিছু অজানা প্রশ্ন। যার সঠিক উত্তরও রহস্যজনকভাবে অজ্ঞাত থেকে যায়। হয়তো কোনও একদিন সেই উত্তর সামনে আসে। কিন্তু ততদিনে সেই উত্তরের মূল্য অনেকটাই কমে যায়।
সরকারের পতনের পিছনে বড় প্রশ্ন
বাংলাদেশ এ শেখ হাসিনা সরকারের সাম্প্রতিক পতনের পিছনের মূল কারণ নিয়েও রয়ে গিয়েছে একাধিক প্রশ্ন। যার অন্যতম, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের জন্যেই কি মূলত সরকারের পতন ঘটেছে? নাকি অন্য কোনও রহস্য রয়েছে লুকিয়ে?’ অন্তত আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক দাবির মধ্যে কোথাও উল্লেখ ছিল না, ‘দেশের সরকারের পতন ঘটাতে হবে’।
অনেকেই সরকারের পতনের জন্য শুধুমাত্র এই আন্দোলনকেই কারণ হিসেবে মনে করছেন না। তাঁদের দাবি, সরকার পতনের একটি গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করেছে এই আন্দোলনকে সামনে রেখে, যা তৃতীয় কোনও শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই আন্দোলন চলার মাঝপথে দাবি করেছিলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের রাশ সে সময়ে আর ছাত্রদের হাতে ছিল না। তৃতীয় কোনও শক্তির হাতে চলে গিয়েছিল আন্দোলনের নেতৃত্ব।
শেখ হাসিনার দাবি
শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট বিকাল নাগাদ পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। এখন তিনি ভারতের কোনও একটি অজ্ঞাত স্থানে সুরক্ষিত রয়েছেন। দেশ ত্যাগের আগে তিনি দেশবাসীর কাছে বক্তৃতার মাধ্যমে কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দেশের সেনাপ্রধান তাঁকে সেই সুযোগ দেননি। পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার জন্য বেঁধে দিয়েছিলেন মাত্র ৪৫ মিনিট সময়।
দেশ ত্যাগের পরও শেখ হাসিনা কিছুদিন ছিলেন নীরব। পরে একাধিক মিডিয়া মারফত জানা যায়, তিনি ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানিয়েছেন, তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জন্য দায়ী আমেরিকা। এখানে আমেরিকাকে সেই ‘তৃতীয় অজ্ঞাত শক্তি’ হিসেবে মনে করছেন তিনি।
যদিও অতীতে দেখা গিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সদ্য পদত্যাগ করা শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক খুব বেশি ভাল ছিল না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘কলের পুতুল’ কখনওই হতে চায়নি তারা। আমেরিকার দাবিকে তারা প্রাধান্য দিতে চায়নি।
মার্কিন ক্রোধ
গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, কোনও এক শ্বেতাঙ্গ তাঁর সঙ্গে দেখা করে দাবি করেছিল, বাংলাদেশ এর একটি বিশেষ অংশ তাদের হাতে তুলে দিলে কোনও প্রতিরোধ ছাড়ায় তিনি নির্বাচনে জিততে পারবেন। তিনি সে সময়ে তার কথায় কোনও রকম আমল দিতে চাননি।
এছাড়াও গত নির্বাচনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা ভাল চোখেও দেখেনি। নির্বাচন বানচাল করাতে যারা উদগ্রীব তাদের ভিসা দেবে না আমেরিকা, নির্বাচনের আগে এমন দাবিও করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনের পরে একাধিক মহল থেকে দাবি উঠেছিল, মার্কিন সরকার বাংলাদেশ সরকারের পতনের জন্য কোনও একটি চক্রান্ত ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে। তারা আরও দাবি করেছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ এ এমন একটি সরকার দেখতে চায়, তাদের হাতে কোনও গণতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকবে না। বলা বাহুল্য এর কিছুদিন পরই শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বহুদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজর রয়েছে বাংলাদেশ এর সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দিকে। চিনের সঙ্গে কৌশলগত লড়াইয়ে এর চেয়ে ভাল অবস্থান আর হতেই পারে না। একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার পাশাপাশি চিনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যথার অন্যতম কারণ এখন। কারণ দেশটি অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
চিন ইতিমধ্যেই বঙ্গোপসাগরে তার আধিপত্য বিস্তারের কাজ শুরু করে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা যে ভাল চোখে দেখবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাই সেন্ট মার্টিন তারা হস্তগত করতে বদ্ধপরিকর। ছোট্ট এই প্রবাল দ্বীপটির আয়তন মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটার। প্রায় ৮ হাজার মানুষের বসতি যুক্ত এই দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ এর মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
দ্বীপটিকে লিজ নেওয়ার জন্য অনেকবারই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি চালিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ দ্বীপটি ছোট হলেও তাদের এখানে একটি সেনানিবাস গঠন করার ইচ্ছা ছিল। তাতে সমগ্র বঙ্গোপসাগরে তারা নির্বিঘ্নে নজরদারি চালাতে পারবে।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে প্রশ্ন
কিন্তু দেশের সার্বভৌমত্ব অখণ্ড রাখতে শেখ হাসিনা সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে কখনওই সেন্ট মার্টিনকে তুলে দিতে চায়নি। শেখ হাসিনার দাবি অনুযায়ী, এই জন্যেই মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে কৌশলে গদি থেকে নামিয়ে ছেড়েছে আমেরিকা।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে ও পরে একাধিক মহল বার বার সন্দেহ প্রকাশ করেছে, এর জন্য ‘তৃতীয় কোনও অজ্ঞাত শক্তি’-র হাত নিশ্চয় রয়েছে। ভারতের সর্বদলীয় বৈঠকের সময়েও বিরোধী দলনেতা রাহুল গাঁধী বাংলাদেশ সরকারের পতনের জন্য বহিরাগত শক্তির কোনও হাত রয়েছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন ভারত সরকারকে। এছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশ এর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন, তারা কখনওই সেন্ট মার্টিনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেবে না। বাংলাদেশের ছাত্র এই জন্যে আন্দোলন করেনি।
তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ সরকারের পতনের সঙ্গে সেন্ট মার্টিনকে ঘিরে থেকে যাচ্ছে একাধিক প্রশ্ন। থেকে যাচ্ছে রহস্য।