বাঘরোল বিড়াল জাতীয় প্রাণীদের অন্যতম। এরা নদীর ধার, পাহাড়ি ছড়া ও জলাভূমিতে বাস করতে পছন্দ করে। চিতা বাঘের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় মাঝে মধ্যে গ্রামবাসীরা এদের চিনতে ভুল করে। তখন বিনা বাক্যে এবং বিনা বিবেচনায় এদের হত্যা করতে উদ্যত হয়। যদিও ২০০৮ সালে এই বাঘরোল বা মেছো বিড়ালকে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাঘরোল বা মেছো বিড়াল ইংরেজিতে ফিশিং ক্যাট মাঝারি আকারের বিড়ালগোত্রের একটি স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যথা ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল, কোস্টারিকা, বলিভিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, এল সালভাদোর এদের বাসস্থান। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিগত কয়েক দশকে মেছো বিড়ালের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমিকে রূপান্তরিত করে বাসযোগ্য জমি করা, বনভূমির পরিমান কমে যাওয়া এবং জলাভূমি হ্রাস পাওয়া এর প্রধান কারণ। এই প্রাণীকে রক্ষা করার জন্য আর্ন্তজাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ২০০৮ সালে বাঘরোল বা মেছো বিড়ালকে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করেছে।
বিড়াল স্তন্যপায়ী, মাংসভোজী প্রাণী। বিড়াল জাতীয় প্রাণীর দলে রয়েছে নিঃসঙ্গচারী, মাংসাশী ও শিকারি শ্রেণীর ৩৪টি প্রজাতি। মূলত এদেরকে দুটি দলে ভাগ করা হয়। বড় বিড়াল যথা সিংহ, বাঘ, চিতাবাঘ এবং ছোট বিড়াল যেমন বনবিড়াল, বাঘরোল ইত্যাদি। অলিগোসিন যুগের শেষার্ধে প্রায় ৪ কোটি বছর আগের জীবাশ্মে বিড়াল গোত্রভুক্ত প্রাণীর অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। প্লায়োসিন যুগের শেষার্ধে প্রায় ১ কোটি বছর আগে আজকের বিড়ালের প্রথম আবির্ভাব ঘটে।
সিংহ দল বেঁধে বাস করলেও বিড়ালরা সাধারণত নিঃসঙ্গচারী। শিকার দেখে চুপিসারে শিকারের কাছাকাছি গিয়ে এবং দ্রুত দৌড়ে বা লাফিয়ে শিকার ধরা এদের অন্যতম স্বভাব। জীবিত বৃহত্তম বিড়াল হল বাঘ ও ক্ষুদ্রতম বনবিড়াল। পশ্চিবঙ্গে এই উভয় প্রজাতির বিড়ালেরই দেখা মেলে। বিড়ালের দাঁত ও নখ সর্বাধিক লক্ষণীয় ও বিশেষীকৃত। এরা আঘাত ও কাটার জন্য দাঁত এবং শিকার ধরে রাখার জন্য নখ ব্যবহার করে। বিড়াল গোত্রের অনেকেই গাছে চড়তে দক্ষ এবং ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন। আঙ্গুলে ভর দিয়ে চলে এবং পায়ের প্যাডের চারপাশে ঘন লোম থাকায় বিড়াল সতর্কভাবে পা ফেলতে পারে। কোনও রকম শব্দও হয় না শিকার ধরার সময়। বিড়ালের মাথার সামনের দুটি বড় চোখ দ্বিনেত্রীয় ও নিখুঁত দৃষ্টি এবং তাড়া করা ও ঝাঁপ দেওয়ার সময় দূরত্ব নির্ধারণের জন্য অপরিহার্য। বিড়াল দিনে ভালো দেখে, তবে রাতে দেখার জন্যও চোখ অভিযোজিত। বড় বড় কান শব্দতরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে। দীর্ঘ ও শক্ত গোঁফ স্পর্শ-সংবেদী এবং রাতে বিশেষভাবে সক্রিয়। ঘড়ঘড় আওয়াজ তোলার ক্ষমতা ছোট বিড়ালের একক বৈশিষ্ট্য এবং বড় বিড়ালের এই ক্ষমতা না থাকলেও তারা সগর্জনে নিজের উপস্থিতি জানাতে পারে।
বাঘরোল সাধারণত নদীর ধারে, পাহাড়ি ছড়া এবং জলাভূমিতে বাস করে। এরা সাঁতারে পারদর্শী হওয়ায় এই ধরনের পরিবেশে সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে। এদের গায়ে ছোপ ছোপ চিহ্ন থাকার জন্য চিতাবাঘ বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। বাঘ আর বাঘরোল এর মধ্যে দৃশ্যগত পার্থক্য এত বেশি যে এদেরকে এক ভাবার সঙ্গত কোনও কারণ নেই। এ যেন সেই চাল কিনতে গিয়ে চালতার খোঁজ করার মত ব্যাপার। তবে চেহারায় এরা বিড়ালের থেকে তাগড়া, গাট্টাগোট্টা।
পশ্চিমবঙ্গে হাওড়া এবং লাগোয়া হুগলিতে মূলত জলাজমির খড়িবনেই বাঘরোল এর সংখ্যাধিক্য। পানের বরজে ব্যবহারের জন্যই খড়িগাছের চাষ এই এলাকায় জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু পান চাষ মার খাওয়ায় চাহিদা কমেছে খড়ির। ফলে কোপ পড়ছে মেছোদের আস্তানায়। খড়িবনের পাশাপাশি হোগলা বন এবং নিচু জলাজমিতেও বাসা বাঁধে বাঘরোল। তাই কম-বেশী সারা রাজ্যেই এদের দেখা মেলে।
মেছো বিড়াল জলার জ্যান্ত মাছ খেতে ভালোবাসে, এটা সত্য। কিন্তু পুকুর বা জলাজমির মাছ কমলেই যত দোষ নন্দ ঘোষ ‘মেছো বিড়াল’ খেয়েছে, এ অপবাদ ঠিক নয়। পশ্চিমবঙ্গে ‘রাজ্য-প্রাণী’-র তকমা জুটলেও তাদের খাদ্য ও বাসস্থান নিয়ে সরকারি স্তরে চিন্তা-ভাবনা কতটা করা হচ্ছে, আদৌ করা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে বারে বারেই। এই প্রাণীদের সঙ্কট নিয়ে গবেষণারত সংস্থা ‘দ্য ফিশিং ক্যাট’ নামে প্রকল্পের গবেষক তিয়াষার আঢ্য উল্লেখ করেছেন, “কোনও প্রাণী নিজের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ খাবার খেতে পারে। সেই হিসেবে একটা বাঘরোল এক দিনে খুব বেশি মাছ খেতে পারে না। তার উপরে বাঘরোল এর বিষ্ঠা পরীক্ষা করে প্রচুর মেঠো ইদুরের দাঁত মিলেছে। ফলে ওরা যে মাছের সঙ্গে সঙ্গে মেঠো ইদুরও খাচ্ছে, সেটা প্রমাণিত।” তাই অনেক ক্ষেত্রেই বাঘরোল নিয়ে গ্রামবাসীদের ভুল ধারণা রয়েছে। সহজেই সব মাছ চুরির দোষ ওদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া যায়।
সম্প্রতি বাঘরোল সংবাদ শিরোনামে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের হাতে নিষ্ঠুরভাবে মৃত্যুর কারণে। উদাহরণ হিসেবে হুগলির জারুয়া গ্রাম, কোন্নগর-বৈদ্যবাটি এলাকা, ভাঙরের চন্ডিগ্রাম, রিষড়ার বাগখাল, বর্ধমান জেলার কাটোয়া ইত্যাদি নানা জায়গার নাম করা যেতে পারে। রাতের বেলায় এরা মূলত গৃহস্থের হাঁস-মুরগি শিকার করে। অনেক সময় আতঙ্কের নিরসনের জন্য খাঁচা পাতলে ধরা পড়ে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই, এগুলি পরিচিত বাঘরোল বা মেছো বিড়াল। এদের মানুষকে আক্রমণ বা ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য-প্রাণীর তকমা পাওয়া এই বাঘের মাসিদের সংরক্ষণের দাবি তুলছেন গবেষক ও পরিবেশকর্মীরা। রাজ্য জীববৈচিত্র্য পর্ষদের বাঘরোল সমীক্ষাসহ কিভাবে এদের রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে আরও সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে। সামাজিক মাধ্যমগুলিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাঘরোল এর ছবি দিয়ে ‘বাঘ পড়েছে, বাঘ পড়েছে’ বা ‘বাঘ ধরেছি, বাঘ মেরেছি’ – এই জাতীয় পোস্ট-ফরোয়ার্ড থেকে বিরত থাকা জরুরি। মনে রাখা দরকার শিডিউল ভুক্ত প্রাণী বাঘরোল মারার শাস্তি ৩ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত কারাবাস।
মানুষখেকো নয়, মাছ শিকারী একটি প্রাণীকে মানুষ ভয় পাচ্ছে কেন? তার মূল কারণ বন্যপ্রাণ নিয়ে সচেতনতার অভাব। এখানেই বন দফতরকে অধিক সচেতন, তৎপর হতে হবে। দায়িত্ব নিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করা, আতঙ্ক বা ভ্রান্ত ধারণা প্রতিহত করা এবং উদ্ধার হওয়া প্রাণীটিকে পুনরায় বেঁচে থাকার সুযোগ নিশ্চিত করা। মনে রাখা দরকার প্রাণীজগতের অস্তিত্ত্ব নির্ভর করে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের উপরেও।