এইভাবে সেই ছোট্ট ননীবালা একদিন বিপ্লবের মহীরুহ হয়ে উঠেছিল। জীবন ব্যাপী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য এই মহিয়সী স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘বাঁকুড়ার গান্ধীবুড়ি’ নামে খ্যাত হন। বাঁকুড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ননীবালা গুহের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
ভারতবর্ষকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেবার জন্য এবং অত্যাচারিত ব্রিটিশদের নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ থেকে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীকে স্বাধীনতার স্বাদ দেবার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন রূপে দেখা গিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের খণ্ড চিত্র। এক্ষেত্রে আমাদের রাঢ় বাংলার, রাঙামাটির জেলা বাঁকুড়ার আবদানও কোনও অংশে কম নয়। এই সময় নারীরা শুধুমাত্র সংসার সীমন্তনী হয়ে অন্দরমহলে বন্দি না থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামেও নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন। তার অন্যতম উদাহরণ হলেন ননীবালা গুহ। যিনি বাঁকুড়ার গান্ধীবুড়ি নামেও পরিচিত।
১৮৮৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এই জেলার ইন্দাসের সমৃদ্ধশালী আকুই গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে ননীবালা রক্ষিত জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৩ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে গ্রামের জগৎদুর্লভ গুহের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু ঠিক দুই বছর পরই স্বামীর অকালমৃত্যু ঘটে। এই অকাল বৈধব্য তাঁর জীবনকে সম্পূর্ণভাবে পালটে দেয়। সংসারের সীমারেখা ছাড়িয়ে বিধবার পোশাক পরেই মাত্র এগারো বছর বয়সে ননীবালা দেবী বিপ্লবী দলে নাম লেখান। এলাকার বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী জগবন্ধু দত্তের হাত ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি আত্মনিয়োগ করেন।
এই মহীয়সী নারী বৈধব্য যন্ত্রণা কাটিয়ে তৎকালীন নারী উপেক্ষিত সমাজে নিজেকে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে উৎসর্গ করেন। কোনও বাধাই যেন সেই সময় তাঁর সম্মুখে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। দুর্বার গতিতে তিনি দেশের কাজে নিজেকে সঁপে দেন। এলাকায় ট্রাঙ্ককল বন্ধের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল তাঁর বিপ্লবী জীবন।
১৯৩০ সালে গাঁধীজীর আইন অমান্য আন্দোলনে ননীবালা দেবী যোগ দিয়েছিলেন। সবরমতী আশ্রম থেকে ডাণ্ডী পর্যন্ত যে অভিযান শুরু হয়েছিল, তিনি ইন্দাস এলাকায় সেই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন। সেই সময় ডাণ্ডী আন্দোলনের আদলে বাঁকুড়া থেকে কাঁথি পর্যন্ত পদযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে বাঁকুড়া থেকে কাঁথি পর্যন্ত পদযাত্রায় অসংখ্য গ্রামীণ মহিলা পথ হাঁটেন। বিলিতি দ্রব্য বর্জন, পিকেটিং, ইন্দাসে বি.ডি.আর রেল লাইন উপড়ে ফেলা, বিষ্ণুপুর আদালতে জাতীয় পতাকা তোলা – এসবই বৈপ্লবিক কাজকর্মে তিনিই নেতৃত্বে দিয়েছিলেন।
ননীবালা গুহের সহজ সরল জীবন যাপন, মানুষের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারা, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি কারণে তিনি এলাকার অসংখ্য মহিলাকে স্বাধীনতা আন্দোলনে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর নির্দেশে বাঁকুড়ার অসংখ্য গ্রাম সেদিন ইংরেজ সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। খাজনা বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে তিনি গ্রেফতারও হন।
ব্রিটিশ পুলিশ অবশ্য বেশি দিন তাঁকে কারাগারে আটকে রাখতে পারেনি। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত হয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে গ্রামে গ্রামে নারী শিক্ষার উদ্দেশ্যে একটি পাঠশালা স্থাপন করেন। ১৯৪৬ সালে সেই পাঠশালা সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে। একই সঙ্গে তিনি নিজের বসতবাড়িটিও স্কুলকে দান করে দেন।
এইভাবে সেই ছোট্ট ননীবালা একদিন বিপ্লবের মহীরুহ হয়ে উঠেছিল। জীবন ব্যাপী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য এই মহিয়সী স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘বাঁকুড়ার গান্ধীবুড়ি’ নামে খ্যাত হন। বাঁকুড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ননীবালা গুহের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
ইন্দাসের গণ্ডী ছাড়িয়ে সাদা থান, সাদা জামা, সাদা চাদর আর পায়ে কালো চটি পরে পায়ে হেঁটেই সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে শাসপুর থেকে শ্রীপুর পর্যন্ত তিনি স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ির মহিলাদের তিনি কড়জোড়ে আবেদন করেন স্বদেশী আন্দোলনের বীর সৈনিকেরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলে তাঁদের যেন ফিরিয়ে দেওয়া না হয়। বাড়িতে যা থাকবে সাধ্য মতো তাই দিয়েই যেন সাহায্য করা হয়। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে বাড়ির মহিলারা সেই সময় স্বদেশী আন্দোলনে মুক্ত হস্তে সাহায্য করেছিল।
ননীবালা দেবীকে শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বললে বোধহয় কম বলা হয়। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সমাজ সংস্কারক। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাঁর কর্মকাণ্ড থেমে যায়নি। তিনি শুরু করেন নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য আন্দোলন।
নিজে স্কুলের গণ্ডী ছোঁয়ার সুযোগ পাননি। তথাপি গ্রামের মেয়েরা নিরক্ষর থাকবে? এটা মেনে নিতে পারেননি তিনি। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্রামের মেয়েদের নিজের বাড়িতে এনে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। গ্রামের মানুষের অকৃত্রিম সহযোগিতায় তিনি ১৯৫৯ সালে গড়ে তোলেন ‘আকুই ননীবালা বালিকা বিদ্যালয়’। তাঁর বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়। ১৯৭১ সালে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর অনুমোদন দেয়।
১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বীকৃতির স্বরূপ তাম্রপত্র সহ পেনশন প্রদান করে। স্থানীয় ব্লক ও পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তিও তৈরি স্থাপন করা হয়। ১৯৯০ সালের ১৭ এপ্রিল ননীবালা দেবীর জীবনাবসান ঘটে।