Sunday, February 16, 2025

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হতেই পিছিয়ে পড়েছিল ভারতের জ্ঞান চর্চা

- Advertisement -

ইতিহাসের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রায় ৮০০ বছর টিকে ছিল। এই ৮০০ বছর তিনটি যুগের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে তাকে। রাজা পরিবর্তন ঘটলে তার শাসন ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় –এও লেগেছিল পরিবর্তনের ছোঁয়া।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

আধুনিক সময়ের Top 10 বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নাম উচ্চারণ করতে বললেই অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, ক্যালিফোর্নিয়া, হার্ভার্ড এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নাম উল্লেখ করতে হয়। যদিও এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কোনওটিই ভারতীয় উপমহাদেশ বা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে নয়। এগুলি সবই প্রায় পশ্চিমা দেশগুলির অংশ। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তাই বহু অর্থ ব্যয়ে পশ্চিমাতেই পাড়ি জমাতে দেখা যায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে।

কিন্তু এগুলির মতো এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় এই ভারতেই এক সময় ছিল, যেখানে পঠনপাঠনের জন্য অতীতে বিভিন্ন দেশ থেকে এই ভারতেই পাড়ি জমাত শিক্ষার্থীরা। হ্যাঁ, না বললেও বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যে এখানে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় –এর কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে এক সময় ‘নালন্দা মহাবিহার’ বলা হত। ‘বিহার’ কথার অর্থ ‘অবিরত দান’। অর্থাৎ এখানে শিক্ষা দানের কোনও শেষ ছিল না। ঐতিহাসিকরা প্রায় সকলেই একমত যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে একই সঙ্গে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করত এবং তাদের পঠনপাঠন করাতেন সহস্রাধিক শিক্ষক।

- Advertisement -

প্রতিষ্ঠা

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৮০০ বছর আগে। তার ৭০০ বছর পর খননকার্য চালানো হয়েছে এখানে। তাই যতটুকু তথ্য এখান থেকে উদ্ধার করতে পেরেছেন ঐতিহাসিকেরা, তা খুবই সামান্য। প্রকৃত ইতিহাস জানতে সাহায্য নেওয়া হয়েছে সমসাময়িক অন্যান্য তথ্য থেকে।

ঐতিহাসিকদের ধারণা, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গুপ্ত সম্রাটদের সময়ে। এই সময়ের একটি সিলমোহর থেকে অনুমান করা হয়, এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সম্ভবত গুপ্ত সম্রাট শক্রাদিত্য, যিনি ইতিহাসে প্রথম কুমার গুপ্ত নামে পরিচিত। তার রাজত্বকাল ছিল ৪১৫ থেকে ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ ওই সময়ের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণী থেকে জানা যায়, প্রথম যুগে শিক্ষা দানের জন্য এখানে একটি ‘সঙ্ঘারাম’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পরে কালে কালে তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে ঘটতে এক সময় এটি হয়ে ওঠে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়।

তিন যুগে যাত্রা

ইতিহাসের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রায় ৮০০ বছর টিকে ছিল। এই ৮০০ বছর তিনটি যুগের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে তাকে। রাজা পরিবর্তন ঘটলে তার শাসন ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় –এও লেগেছিল পরিবর্তনের ছোঁয়া। গুপ্ত সম্রাটরা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠার প্রথম যুগে এখানে হিন্দুশাস্ত্রগুলিই পঠনপাঠনের প্রধান বিষয় ছিল। কিন্তু অন্য ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রগুলিও এখানে যত্নসহকারে স্থান পেয়েছে। পরে এই যুগের শেষের দিকে সম্রাট নরসিংহগুপ্ত বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হয়ে পড়লে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রগুলির পঠনপাঠনে গতি পায়।

গুপ্ত সম্রাটদের পতনের পর শাক্য বংশের রাজা হর্ষবর্ধনের নজরে আসে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। তার সময়ে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে এই মহাবিহারের। তার সময়ে বহু নতুন নতুন বিহার, মন্দির, মঠ প্রতিষ্ঠা হয় এখানে। এমনকি শিক্ষার ক্রম উন্নতিতে হর্ষবর্ধন ১০০ গ্রামের রাজস্ব এখানে মঞ্জুর করেছিলেন। মূলত তার সময়কেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় –এর স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে।

এরপর অষ্টম শতাব্দীতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা। তারা প্রায় ৪০০ বছর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় –এর। এই যুগেও অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছিল এর। একাধিক তথ্য বলছে, পাল সম্রাট ধর্মপাল নিজেই ছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় –এর শিক্ষার্থী।

শিক্ষার বিষয়

আগেই বলা হয়েছে, ‘বিহার’ কথার অর্থ ‘অবিরত দান’। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া যায়, এখানে শিক্ষা শাস্ত্রের প্রায় সমস্ত বিষয়ই পড়ানো হত। গুপ্ত পরবর্তী যুগে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।

হিউয়েন সাং এর বিবরণী থেকে জানা যায়, বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান ও হীনযানের সমস্ত অধ্যায়, সেই সঙ্গে বেদ, ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র বা ভেষজবিদ্যা, জাদুবিদ্যা, শরীরচর্চা, জ্যোতিষশাস্ত্র, গণিত প্রভৃতি বিষয়গুলি এখানে পড়ানো হত।

হিউয়েন সাং আরও উল্লেখ করেছেন, তার শিক্ষাকালে এই বিহারে প্রায় ১৫১০ জন শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষার্থী ছিলেন লক্ষাধিক। তার মতোই বহু শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত বিশেষ করে চিন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, কোরিয়া, তিব্বত থেকে অধ্যায় করতে আসত এখানে।

গ্রন্থাগারের আয়তন

এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটিও যে বৃহৎ আকারের হবে তাতে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। প্রায় ৮০০ বছর ধরে এখানে সঞ্চিত হয়েছিল লক্ষ লক্ষ গ্রন্থ বা পুঁথি। এখানকার গ্রন্থাগারকে বলা হত ‘ধর্মগঞ্জ’। একাধিক সূত্রে জানা যায়, মোট তিনটি বহুতল বিশিষ্ট ভবন জুড়ে এই গ্রন্থাগারটি গঠিত হয়েছিল। জানা যায়, বাংলা ভাষার প্রথম গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’ এই গ্রন্থাগারেই সঞ্চিত ছিল। কিন্তু এই গ্রন্থাগারের কোনও গ্রন্থই বর্তমানে আর প্রায় নেই। প্রায় ৮০০ বছর পূর্বে বখতিয়ার খলজির আক্রমণে তার অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

তবে হিউয়েন সাং, ইৎসিং সহ আরও বহু বহিরাগত শিক্ষার্থী পঠন শেষে ফিরে যাওয়ার সময় এখান থেকে বহু গ্রন্থ নিজেদের সঙ্গে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের দেশে। সেই সব কিছু গ্রন্থ বা পুঁথি আজও বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে সঞ্চিত রয়েছে।

ধ্বংসলীলা

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একাধিকবার বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়েছে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের ধারণা, এই রকম একটি সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ চালিয়ে তাকে ধ্বংস করে দেওয়া প্রায় কারওই মূল উদ্দেশ্য ছিল না। মূল উদ্দেশ্য ছিল সেখানে সঞ্চিত রত্নভাণ্ডার লুণ্ঠন করা।

গুপ্ত সম্রাটদের সময়ে একাধিকবার ভারতে লুণ্ঠন চালিয়েছে হুন রাজারা। এই সময়ে সবচেয়ে বড় আঘাত হানে হুন রাজা মিহিরকুল। স্কন্দগুপ্তের সময়ে এই আক্রমণ পৌঁছে যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। বহু ক্ষয়ক্ষতিও হয় সেই সময়ে। যদিও পরবর্তীকালে গুপ্ত সম্রাটরা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় –কে পুনর্গঠন করেছিলেন।

সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময়ে আর একবার আক্রান্ত হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। এবার আক্রমণ চালিয়েছিলেন বঙ্গের অধিপতি শশাঙ্ক। তার উদ্দেশ্য ছিল মূল্যবান রত্ন সামগ্রী লুণ্ঠন। যদিও এই আক্রমণের বিশেষ কোনও প্রামাণ্য নথি নেই।

তবে শেষ আঘাত হানে তুর্কির লুঠতরাজ বখতিয়ার খলজি। আর সেই আঘাত আর কোনওভাবেই সামলে উঠতে পারেনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। এর পর থেকেই ধ্বংস হতে শুরু করে এই মহাবিহার। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় –এর উপর এই ধ্বংসলীলা মিনহাজ রচিত তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। গ্রন্থটি ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মেজর এইচ জি রাভেত্রি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। সেখান থেকে জানা যায়, প্রায় ৬ মাস ধরে বখতিয়ার খিলজির সেনারা এখানে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে বিনা কারণে হত্যা করা হয়। বহু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এলাকা ছেয়ে পলায়ন করে। এখানকার গ্রন্থাগারটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। এমনকি কয়েক মাস পুড়তে সময় লেগেছিল সেখানকার গ্রন্থ বা পুঁথিগুলি। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের দাবি, লুটপাট চালানোর পরেও থেমে ছিল না বখতিয়ার খলজির সেনারা। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে হত্যা ও তার শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করাও ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

পরবর্তী সময়

এরপর আর কোনওভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীকালে অনেকেই চেষ্টা করেছিলেন এই মহাবিহারকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। ততদিনে শুরু হয়েছিল ভারতে মুসলমান সাম্রাজ্য। ঐতিহাসিকেরা যাকে ভারতীয় ইতিহাসের ‘মধ্যযুগ’ বলেছে। ইতিহাস এই মধ্যযুগকে আবার ‘অন্ধকার যুগ’ নামেও পরিচয় দিয়েছে। এই যুগে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল একেবারেই ক্ষীণ। অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল ভারতীয় পরিবেশ। বলা বাহুল্য, তার প্রভাব থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি অধিকাংশ মানুষ।

পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটলে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে পাশ্চাত্য শিক্ষা। ক্রমে তার বিস্তৃতি ঘটে। এখন এই উপমহাদেশে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠেছে। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থারও সূচনা ঘটেছে। কিন্তু নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় –এর মতো মুক্তমনা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষা ব্যবস্থা আদৌ কী ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে?

- Advertisement -

এই রকম আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সাম্প্রতিক খবর