তিনি দৃষ্টিহীন একজন ধূপ ব্যবসায়ী। যদিও জন্মগতভাবে তিনি দৃষ্টিহীন নন, ২০১৪ সালের পরেই তাঁর জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের স্রোত। কিন্তু থেমে থাকেনি তাঁর স্বাভাবিক জীবন-যাপন। অন্য সাধারণ মানুষের মতোই শিখে নিয়েছেন বেঁচে থাকার লড়াই। তাঁর এই লড়াই যথেষ্ট অনুপ্রেরণা যোগাবে অন্য দৃষ্টিহীন দেরকেও।
“আমি সবকিছু করতে পারি না, কিন্তু কিছু একটা পারি তো। আর যা পারি, সেখানে আমার ব্যর্থ হওয়া চলবে না।” নিজের আত্মজীবনীতে এমনটাই লিখে গিয়েছেন বিখ্যাত মার্কিন শিক্ষাবিদ হেলেন কেলার। যিনি নিজে ছিলেন সম্পূর্ণ বধীর ও দৃষ্টিহীন। দৃষ্টিহীনতা তাঁর জীবনে কোনওরকম প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, সেটা বারবারই প্রমাণ করেছেন তিনি। দৃষ্টিহীন হয়েও তিনি হয়েছেন একজন সফল মানুষ।
হেলেন কেলারের এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নিজের জীবন যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন বীরভূম জেলার দুরাজপুর ব্লকের পানুরিয়া পঞ্চায়েতের অন্তর্গত আদুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা সুমিত ঘোষ। তিনি দৃষ্টিহীন একজন ধূপ ব্যবসায়ী। যদিও জন্মগতভাবে তিনি দৃষ্টিহীন নন, ২০১৪ সালের পরেই তাঁর জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের স্রোত।
কিন্তু থেমে থাকেনি তাঁর স্বাভাবিক জীবন-যাপন। অন্য সাধারণ মানুষের মতোই শিখে নিয়েছেন বেঁচে থাকার লড়াই। তাঁর এই লড়াই যথেষ্ট অনুপ্রেরণা যোগাবে অন্য দৃষ্টিহীন দেরকেও।
অন্য অনেকেই আছে (দৃষ্টিহীন অথবা সাধারণ মানুষ), যারা জীবনের রসদই খুঁজে পায়নি, জীবনের মানেটাই উদ্ধার করতে পারেনি। সেখানে সুমিত দৃষ্টিহীন হয়েও থেমে থাকেননি। কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন ধূপ ব্যবসাকে। কলকাতা অথবা আসানসোলের বাজার থেকে পাইকারি দরে কাঁচা ধূপ নিয়ে এসে বাড়িতেই নিজের হাতে প্যাকিং করেন। তারপর রোজ ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পরেন ফেরী করতে। পথে পথে আর ট্রেনে ট্রেনে ফেরী হয় তাঁর নিজের প্যাকিং করা ধূপের প্যাকেট। একাজে অন্য কাউকেই তাঁকে সাহায্য করতে হয় না।
বছর পঁচিশের এই দৃষ্টিহীন ধূপ ব্যবসায়ী সুমিত জানালেন, ২০১৪ সালের ৫ আগষ্ট পর্যন্ত তিনি চোখে স্বল্প দেখতে পেতেন। পরে ছোট্ট একটি দুর্ঘটনায় তাঁর সম্পূর্ন দৃষ্টিশক্তি চলে যায়। এই প্রতিবন্ধকতা অবস্থা কাটিয়েও তিনি মাধ্যমিকে ৬০ শতাংশ ও উচ্চমাধ্যমিকে ৭০ শতাংশ নাম্বার পেয়ে সাফল্যের সঙ্গে উর্ত্তীণ হয়েছেন। প্রশাসনের তরফ থেকেও তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে।
তবে ধূপ ব্যবসার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন, জিজ্ঞেস করাতে তিনি জানালেন, বাড়িতে বাবা ও দাদা উপার্জন করলেও নিজের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার তাড়না ছিল নিজের ভিতরেই। অবশেষে চিন্তা আসে ধূপকাঠি বানিয়ে ট্রেনে ফেরী করার। ঝাড়খণ্ডের বন্ধু বাবুরাম সরেনের সহযোগিতায় প্রথমে কলকাতা ও পরে আসানসোল থেকে পাইকারি ধূপকাঠি কিনে আনতে শুরু করলেন তিনি। তারপর প্যাকিং করার কাজটা বাড়িতেই হয়। তাঁর স্ত্রী প্রতিমা ঘোষও এখন এই কাজে তাঁকে সাহায্য করেন। তিনিও একজন দৃষ্টিহীন মহিলা। তারপর প্যাকিং করা সেই ধূপকাঠির ঝোলা নিয়ে তিনি প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে পড়েন ফেরী করতে। ঝোলায় ধূপ ছাড়াও থাকে সারাদিনের জল-খাবার।
সুমিত রোজ সকাল সাড়ে ৬টায় ট্রেন ধরেন কচুজোড় রেলষ্টেশন থেকে। সাঁইথিয়া-অন্ডাল লোকালে প্রথমে সাঁইথিয়া, পরে সাঁইথিয়া থেকে পৌনে ৮টার ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে প্রান্তিক নামেন। প্রান্তিক থেকে সাড়ে ৮টার রামপুরহাট-বর্ধমান লোকালে খানা জংশন পর্যন্ত যান। খানা জংশন থেকে তিনি যান রাজবাঁধ। পরে রাজবাঁধ ডাউনে আবার ফিরে আসেন খানা জংশনে। খানা জংশন থেকে ১২টা ৫-এর লোকালে চলে যান অন্ডাল জংশন। এখানে নেমে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার দুপুর ২টোর আন্ডাল-সাঁইথিয়া লোকালে ফিরে আসেন কচুজোড়। এটাই সুমিতের সারাদিনের রুটিন।
চলতি পথে ফেরী করা ধূপ বেঁচে তিনি প্রতিদিন গড়ে রোজগার করেন ২০০-৩০০ টাকা। দিনের শেষে সেই টাকা তুলে দেন পরিবারের হাতে। এভাবেই বেশ চলে যায় তাঁর বাবা, মা, দাদা, বউদি, স্ত্রী ও মেয়ে পিউ-কে নিয়ে সুখের সংসার। মাঝে একবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল লকডাউন। লকডাউনের সময়টাতে তার ছোট্ট রোজগার সম্পূর্ণ বন্ধই ছিল। বাড়িতেই অসহায়ভাবে দিন কাটিয়েছেন তিনি। অন্যের কাছে দয়া প্রার্থনা করে হাত পাতা অভ্যাস তাঁর কোনও দিনও ছিল না। তাই জীবন সংগ্রামে এই রকম কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁকে আগে কখনও পড়তে হয়নি। যদিও লকডাউনের পর তাঁর স্বাভাবিক জীবন পুনরায় ধীরে ধীরে ফিরে আসে।
যাইহোক, দৃষ্টিহীন হয়েও শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরে তিনি নিজেকে যেভাবে এই পর্যন্ত দাঁড় করাতে পেরেছেন, তা অবশ্যই বড় প্রশংসার যোগ্য। অন্য দৃষ্টিহীন দেরকেও যথেষ্ট অনুপ্রেরণা যোগাবে তাঁর এই অপার ইচ্ছাশক্তি।