ঢেঁড়ি দেখতে ছিল অনেকটা উপজাতি গোষ্ঠীর একমুখী ‘লাগড়া’-র মতো। ঢেঁড়ি বাদকেরা এটিকে ব্যবহারের সময় কাঁধে ঝুলিয়ে নিত। কখনওবা তারা বাম কাঁখে রেখে ডান হাতের শক্ত লাঠিতে এটিকে পিটিয়ে থাকত। ঢোলের মতোই ঢেঁড়ি -র প্রতিধ্বনি পৌঁছে যেত অনেক দূর-দূরান্তে। এটি ঢোলের মতোই পশু চামড়া দিয়ে নির্মিত। কিন্তু আধুনিকতার ভিড়ে ক্রমশ হারিয়েই যাচ্ছে এই ঢেঁড়ি -র পরিচিত আওয়াজ। কারণ নতুন প্রজন্মের কাছে প্রয়োজন হারিয়েছে এই বাদ্যযন্ত্রটির।
গ্রাম-বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকবাদ্যের ইতিহাসে ‘ঢেঁড়ি’ অতিপরিচিত একটি বাদ্যযন্ত্র। লৌকিক বাদ্যযন্ত্রের ক্রমবিকাশের মধ্যে ঢাক, ঢোল, কাঁসর এর সঙ্গে ঢেঁড়ি -র নাম অব্যশই থাকবে। আর এই ঢেঁড়ি -র ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। বলতে গেলে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস ও রাজ-রাজারাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে এই ঢেঁড়ি জড়িয়ে রয়েছে অঙ্গাঙ্গীভাবে। কারণ অতীতে সম্রাট বা রাজার কোনও জরুরী ঘোষনা রাজ্যবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে প্রজার দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষেত্রে ঢেঁড়ি বা ঢেঁড়ার কোনও বিকল্প ছিল না।
ব্রিটিশ আমলে নবাব, সম্রাট বা রাজার যুগ শেষ হলেও এই ঢেঁড়ি -র যুগ ছিল চলমান। বাংলার সামন্ত বা জমিদারেরাও ঢেঁড়ি ব্যবহার করত। এখানে এই বাদ্যযন্ত্রটির ব্যবহার ছিল মূলত রাজকোষে খাজনা জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানাতে অথবা সামন্ত বা জমিদারের কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য প্রজাদের কাছে পৌঁছে দিতে।
সেসময়ে এই ঢেঁড়ি যারা বাজাত তাদেরকে ঢেঁড়ি বাদক বলা হত। এরা ছিল সমাজের নিম্নবর্গের একশ্রেণীর মানুষ। সাধারণত ‘বাগদী’ বা ‘বায়েন’ সম্প্রদায় থেকে তারা আসত। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, মাইক-মাইক্রোফোন বা মোবাইলের যুগ ছিল না তখন। রাজ্যবাসীর কাছে রাজা বা জমিদারের কোনও বিশেষ ঘোষণা পৌঁছে দেওয়ার অন্য কোনও বিকল্প মাধ্যমও ছিল না। একমাত্র মাধ্যম ছিল এই ঢেঁড়ি বাদকেরা। তারা ছোট-বড় নানান আকারের ঢেঁড়ি নিয়ে পৌঁছে যেত এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে। ঢেঁড়ি বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করত প্রজাদের। তারপর রাজা বা জমিদারের নির্দিষ্ট মূল বক্তব্য তুলে ধরত তাদের কাছে। তাই দীর্ঘদিন ধরেই এই ঢেঁড়ি বা ঢেঁড়া গ্রাম-বাংলার অতি প্রয়োজনীয় ও জনপ্রিয় একটি বাদ্যযন্ত্র হিসাবে স্থায়ী ছিল।
জমিদারি আমল শেষ হওয়ার পরেও অবশ্য কিছুদিন টিকে ছিল এই বাদ্যযন্ত্রটি। তবে ব্যবহার একই থাকলেও উদ্দেশ্য বদলে যায়। রাজা বা জমিদারের থেকে ঢেঁড়ি চলে আসে আম-জনতার হাতে। এই সময় জনসাধারণ তাদের কোনও বিশেষ ঘোষণা দিতে নির্দিষ্ট কোনও অঞ্চলের মধ্যে ঢেঁড়ি -র ‘দ্রিম’ ‘দ্রিম’ আওয়াজ ব্যবহার করতে শুরু করে। স্থানীয় ক্লাব, সংগঠন, কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে গ্রামবাসীদের হাজির করাতে, কোনও উৎসব অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে, বিশেষ কোনও দেবতার গ্রামে আগমন বা গ্রাম পরিক্রমা প্রভৃতির ক্ষেত্রে ঘোষণা দিতে এর ব্যবহার হতে থাকে। আরও পরে অবশ্য শুধু যাত্রাপালা, কীর্তনের মতো অনুষ্ঠানে ঢেঁড়ি -র ব্যবহার ব্যবহার সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
ঢেঁড়ি দেখতে ছিল অনেকটা উপজাতি গোষ্ঠীর একমুখী ‘লাগড়া’-র মতো। ঢেঁড়ি বাদকেরা এটিকে ব্যবহারের সময় কাঁধে ঝুলিয়ে নিত। কখনওবা তারা বাম কাঁখে রেখে ডান হাতের শক্ত লাঠিতে এটিকে পিটিয়ে থাকত। ঢোলের মতোই ঢেঁড়ি -র প্রতিধ্বনি পৌঁছে যেত অনেক দূর-দূরান্তে। এটি ঢোলের মতোই পশু চামড়া দিয়ে নির্মিত।
কিন্তু আধুনিকতার ভিড়ে ক্রমশ হারিয়েই যাচ্ছে এই ঢেঁড়ি -র পরিচিত আওয়াজ। কারণ নতুন প্রজন্মের কাছে প্রয়োজন হারিয়েছে এই বাদ্যযন্ত্রটির। কোনও ঘোষণা, সংবাদ বা প্রচার অতি দ্রুত বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে এই আধুনিক যুগে উন্নত মাধ্যমের কোনও শেষ নেই। মানুষের রুচিরও পরিবর্তন ঘটেছে ব্যাপকভাবে।
তবে জনপ্রিয়তা কমলেও গ্রাম্যজীবনের রেওয়াজ অবশ্য কমেনি এখনও। বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলার ময়ূরাক্ষী নদীর সন্নিকটস্থ বেশ কয়েকটি গ্রামে আজও কোনও না কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় উৎসবে বাসিন্দাদের আগাম ঘোষণা দিতে ঢেঁড়ি -র ব্যবহার রয়েছে। তবে এখানেও এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ রয়েছে শুধুমাত্র প্রবীণ নাগরিকদের মধ্যে। নতুন প্রজন্ম এক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহী নয়। তা স্বত্বেও ঢেঁড়ি -র দ্রিম-দ্রিম শব্দ শুনে আজও উৎসুক গ্রামবাসী জানতে চাই ‘কীসের ঢেঁড়ি গো?’