ব্রিটিশ পক্ষীবিদ ই পি গি ‘দি ওয়াইল্ডলাইফ অব ইণ্ডিয়া’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। যেখানে উল্লেখ ছিল জাতিঙ্গা গ্রামের এই পক্ষী আত্মহত্যার ঘটনা। সমগ্র বিশ্বের পক্ষীবিশারদরা তখন নড়েচড়ে বসেন। ছুটে আসেন এই গ্রামে আসল কারণ জানতে। যদিও সেই গবেষণা আজও চলছে কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ এখনও বের করতে পারেননি তাঁরা।
এ যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী। এখানে এক অদ্ভুত ও অজানা আকর্ষণে ঝাঁকে ঝাঁকে আকাশ থেকে নেমে আসে হাজারও পাখির দল। তারপর বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো শীতল কোনও পথ। একবার দুবার নয়, নিশ্চিতভাবে বছরের পর বছর এভাবেই আত্মহত্যা করে চলেছে পাখিরা। একাধিক গবেষণাতেও এর সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ আজও জানা যায়নি।
এখানে মৃত্যুপুরী বলতে অসমের একটি অখ্যাত গ্রাম জাতিঙ্গা গ্রামের কথা বলা হচ্ছে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা হঠাৎই স্থানীয় বাড়ি বা কোনও উঁচু গাছের সঙ্গে নিজেদের ধাক্কা গালায়। তারপর ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। অদ্ভুত এই দৃশ্য সচক্ষে দেখতে প্রতি বছরই এই সময় অসংখ্য পর্যটকের ভিড় জমে এই জাতিঙ্গা গ্রামে।
ঘটনাটি প্রথম নজরে আসে ১৯০৫ সাল নাগাদ। এই জাতিঙ্গা গ্রামে সেসময় বাস করতেন একদল নাগা। বছরের এই সময়টিতে একদিন তাঁদের একটি মহিষ হারিয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে মশাল জ্বালিয়ে তাঁরা মহিষ খুঁজতে বের হন। তখনই ঝাঁক বেঁধে পাখিদের এই আত্মহত্যার ঘটনা তাঁদের নজরে আসে। সে সময় তাঁরা প্রাকৃতিক কোনও অপশক্তির প্রভাব চলছে বলে সেই স্থান ত্যাগ করেন।
পরে ১৯১০ সাল নাগাদ আবিস্কার হয়, জাতিঙ্গা গ্রামে পাখিদের এই অদ্ভুত আত্মহত্যার ঘটনা শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসেই ঘটে থাকে। এই সময়ে প্রবল বৃষ্টি নামে অসমে। চারিদিকেই শুধু জল থইথই। বন্যার পরিস্থিতিও ঘটে থাকে প্রায় বছর।
তবে বিশ্বের দরবারে প্রথম এই ঘটনা সামনে আসে ১৯৫৭ সাল নাগাদ। ওই বছর ব্রিটিশ পক্ষীবিদ ই পি গি ‘দি ওয়াইল্ডলাইফ অব ইণ্ডিয়া’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। যেখানে উল্লেখ ছিল জাতিঙ্গা গ্রামের এই পক্ষী আত্মহত্যার ঘটনা। সমগ্র বিশ্বের পক্ষীবিশারদরা তখন নড়েচড়ে বসেন। ছুটে আসেন এই গ্রামে আসল কারণ জানতে। যদিও সেই গবেষণা আজও চলছে কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ এখনও বের করতে পারেননি তাঁরা।
কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, এসবই স্থানীয় গ্রামবাসীদের কারসাজি। বর্ষা মরশুমের এই সময়টিতে খাদ্যাভাব দেখা দিলে তারা পাখি শিকারের পথ বেছে নেয়। রাতের অন্ধকারে গ্রামে আলো জ্বালালে উড়ন্ত পাখিরা নেমে আসে ভূমির দিকে। তখন গ্রামবাসীরা তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলে।
যদিও স্থানীয়দের দাবি এই সময় প্রাকৃতিক কোনও কু-প্রভাব পড়ে পাখিদের উপর। ফলে তারা আত্মহত্যার পথ নেয়। বলা বাহুল্য এই সমস্ত পাখির মধ্যে অধিকাংশই রয়েছে মাছরাঙা ও বক জাতীয় প্রায় ৪৪ প্রজাতির পাখি।
তবে এখনও পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য গবেষণাটি করেছেন ডঃ সুধীর সেনগুপ্ত। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত জুলজিকল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার এই পক্ষীবিদ এই ঘটনার জন্য স্থানীয় আবহাওয়া, বায়ুচাপের হঠাৎ পরিবর্তন, মাধ্যাকর্ষণ, জাতিঙ্গা পাহাড়ের পাথরের সঙ্গে মিশে থাকা উচ্চশক্তি সম্পন্ন খনিজ চুম্বক-কে দায়ী করেছেন। তাঁর দাবি, প্রবল বর্ষণে জাতিঙ্গা গ্রামের পাহাড়ি উপত্যকায় মাধ্যাকর্ষণ ও চুম্বকশক্তির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। যার প্রভাব পড়ে পাখিদের স্নায়ুতন্ত্রের উপর। ফলে পাখিরা এই এলাকার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এই রকম আচরণ করে থাকে। অনেক পক্ষীবিদই তাঁর এই দাবির সঙ্গে সহমত হয়েছেন।
তবে শুধু জাতিঙ্গা গ্রামেই নয়, পাখিদের এই আশ্চর্য আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছে মালয়েশিয়া আর ফিলিপিন্সেও।