যোগমায়া মানেই দেবী দুর্গা। মহামায়া। শক্তির আর এক রূপ। বঙ্গদেশের বহু প্রান্তে জন্মাষ্টমী তে যোগমায়ার জন্মদিনকে স্মরণ করেই কাঠামো পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। আর সেই কাঠামোর ওপরই প্রতিষ্ঠা করা হয় শারদীয় দুর্গাকে। আশ্বিনে যার পুজোকে কেন্দ্র করে পালন করা হয় বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব।
পেরিয়ে গেল জন্মাষ্টমী। সমগ্র বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এ এক অন্যতম বড় উৎসব। বিশেষ আড়ম্বর করে আদরের গোপাল ঠাকুরকে আরাধনা করা হয়েছে মন্দির থেকে মন্দিরে। কিন্তু জন্মাষ্টমী র দিনে যে তাঁরও জন্ম হয়েছিল। তাঁরও বিশেষ রীতিতে এদিন আরাধনা করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁকেই মনে রাখেনি কেউ। অথচ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে একই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। বলতে গেলে, শ্রীকৃষ্ণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই মূলত জন্ম হয়েছিল তাঁর। করেছেন ত্যাগ স্বীকারও। জন্মাষ্টমী যে আজ তাঁরও প্রাপ্য ছিল।
ঘটনাটি জানতে এবার একটু মহাভারতের যুগে ফিরে যেতে হয়। যদিও অনেকের কাছেই ঘটনাটি আজ নতুন কিছু নয়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ অহংকারী ও অত্যাচারী মথুরার রাজা কংস যখনই দৈববাণী পান, তাঁর বোন দেবকীর অষ্টম পুত্র সন্তানের হাতে তাঁর মৃত্যু ঘটবে, তখন তিনি আরও কঠোর হয়ে ওঠেন। নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় বোন দেবকী ও তাঁর স্বামী বসুদেবকে কারাগারে আটকে রাখলেন। অপেক্ষা করতে থাকলেন বোনের অষ্টম পুত্র সন্তান জন্মানোর জন্য।
এক এক করে কারাগারেই দেবকীর পুত্র সন্তান জন্মাতে লাগল। কংস দীর্ঘায়ু লাভ ও নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অষ্টম সন্তান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাননি। এক এক পরে জন্মের পর পরই দেবকীর সমস্ত সন্তানকে হত্যা করতে শুরু করেন।
অবশেষে উপস্থিত হয় সেই বিশেষ দিন, যেদিনে জন্ম নেবে কংসের বধকারী সন্তান শ্রীকৃষ্ণ। দিনটি ছিল ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথি। প্রচণ্ড ঝড়-জলের রাত। কারাগারের প্রহরীরা সকলেই প্রায় ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়েছে তখন। জন্ম নিলেন শ্রীকৃষ্ণ, দেবকীর অষ্টম পুত্র সন্তান। কিন্তু এই সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখবে কে? এর হাতেই তো কংসের বধ হওয়ার কথা।
আবারও এল দৈববাণী। জানা গেল, যমুনার ওপারে গোকুল গ্রামে মা যশোদার কোলে এই দিনেই অপরাহ্ণে জন্ম নিয়েছেন কন্যা সন্তান, যোগমায়া। তাঁর সঙ্গেই অদল-বদল করতে হবে শ্রীকৃষ্ণকে। আর এই দুঃসাধ্য কাজটি স্বয়ং বসুদেবকেই করতে হবে।
বসুদেব বীভৎস ঝড়-জলকে উপেক্ষা করে, অতল যমুনাকে ডিঙিয়ে এই অসাধ্য কাজটিও করলেন এই রাতে। মা যশোদার কোলে পৌঁছে গেল শ্রীকৃষ্ণ, আর দেবী দেবকীর কোলে ফিরে এলেন যোগমায়া। শিশু কন্যার রোদনে ঘুম ভেঙে গেল কংসের। ছুটে এলেন কারাগারে। দেখলেন আর অনুভব করলেন, তাঁর হিসেব যাচ্ছে গুলিয়ে। জন্মানোর কথা ছিল একটি পুত্র সন্তানের, যে কিনা তাঁকে বধ করবে। অথচ জন্ম নিয়েছে কন্যা সন্তান।
যদিও কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি কংস। কন্যা সন্তানটিকেই হত্যা করতে উদ্যত হলেন। তাঁর পা ধরে আছাড় মারলেন পাথরের ওপর। কিন্তু শিশু কন্যাটিকে হত্যা করা কি অতই সহজ। তাঁর জন্মই যে হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকে বাঁচিয়ে রাখতে, কংসকে বধের উদ্দেশ্যে। তিনি যে স্বয়ং যোগমায়া, দেবী দুর্গা।
পাথরে আছড়ে পরার মুহূর্তেই তাঁর আসল রূপ সম্মুখে উপস্থিত হল কংসের। দশ হাতে ধরা রয়েছে তাঁর সমরাস্ত্র। কংসকে জানিয়ে দিলেন, ‘তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’
তারপর কি হল যোগমায়ার? সে ইতিহাস খুব কম জনই জানে। বলতে গেলে, জানার প্রয়োজনই মনে করেনি কেউ। সবাই তখন শ্রীকৃষ্ণের লীলায় আচ্ছন্ন। তাঁর প্রেমে মগ্ন। ভুলে গেল যোগমায়াকে। অথচ যোগমায়া না থাকলে সেদিনের দেবকীর সেই অষ্টম পুত্র সন্তান আজ শ্রীকৃষ্ণ হয়ে উঠতে পারতেন? পারতেন কংসের মতো এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ অহংকারী, কঠোর ও অত্যাচারী রাজাকে বধ করতে? পারতেন মহাভারতের অপরাজেয় নায়ক হতে?
যদিও এসব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর এখন কোনও প্রয়োজনই নেই। কারণ কথায় আছে, ‘শ্রীকৃষ্ণের লীলা কে বুঝেছে কখন।’ বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী, যোগমায়া-ই নাকি শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে মা যশোদার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। তবুও যে কন্যা সন্তানটি সমস্ত ‘আর্যবত’-কে ন্যায় ও সত্যের দিশা দেখানোর প্রাণপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের রক্ষাকর্তা হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন এবং জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নিজের জীবন বিপন্ন করে মহা ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, জন্মাষ্টমী তে তাঁকে স্মরণ করা তো যেতেই পারে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাশাপাশি দেবী যোগমায়ার জন্মদিন আজকের দিনে বিশেষ আড়ম্বরে পালন করলে ক্ষতি কোথায়।
তবে এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, সবাই যে ভুলে গিয়েছে যোগমায়াকে তা কিন্তু নয়। কারণ যোগমায়া মানেই দেবী দুর্গা। মহামায়া। শক্তির আর এক রূপ। বঙ্গদেশের বহু প্রান্তে জন্মাষ্টমী তে যোগমায়ার জন্মদিনকে স্মরণ করেই কাঠামো পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। আর সেই কাঠামোর ওপরই প্রতিষ্ঠা করা হয় শারদীয় দুর্গাকে। আশ্বিনে যার পুজোকে কেন্দ্র করে পালন করা হয় বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব।