জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, অ্যাপোলো মিশনের সময় চাঁদ এর বুকে কয়েকটা রিফ্লেক্টার বসিয়েছিলেন মহাকাশচারীরা। সম্প্রতি তার ওপর লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করে তাঁরা বুঝতে পারছেন, চাঁদ সত্যিই ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে পৃথিবীর থেকে। এই দূরে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে তাঁরা ‘লুনার রিশেসন’ বলেছেন।
চাঁদ এর সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ক যেন একেবারেই মা ও ছেলের মতো। ছেলের জন্ম যেমন হয় মায়ের গর্ভে। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে ভূমিষ্ঠ হয় ও নাড়ী ছেদন করে তাকে ধীরে ধীরে আলাদা করে দেওয়া হয়। এও যেন ঠিক তেমনই। সবচেয়ে বেশি যে যুক্তিটি মেনে নেওয়া হয়েছে তার সূত্র ধরে বলা যায়, পৃথিবী জন্মের অল্প কিছুকালের মধ্যে থিয়া নামের একটি বড় আকারের বস্তুর সঙ্গে তার সংঘাত বাধে। এই সংঘাতের ফলে পৃথিবীর শরীরের একটি অংশ ভেঙে গিয়ে জন্ম হয় চাঁদ এর। তারপর পৃথিবীর কাছে থেকে তার চারপাশে ঘুরতে শুরু করে।
ছেলে সাবালক হলে যেমন মাকে সাহায্য করে, এক্ষেত্রে চাঁদ কেও ধরে নেওয়া যেতে পারে সে এখন সাবালক। কারণ জন্মের কিছুকাল পর থেকেই যুগ যুগ ধরে পৃথিবীকে নানান দিক থেকে সাহায্য করে এসেছে চাঁদ। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই যেমন পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিকে চাঁদ ই রেখেছে নিয়ন্ত্রণে। নাহলে দ্রুত ঘূর্ণনের জন্য একই দিনে অন্তত দুবার সূর্য দর্শন করত পৃথিবীবাসী।
তাই মানতেই হবে, চাঁদ এর কারণে চব্বিশ ঘণ্টায় একবার দিন আর একবার রাত হয় পৃথিবীতে। যার ফলে এখানে উদ্ভব ঘটেছে জীবনের। পালটে গিয়েছে গোটা পৃথিবীর পরিবেশ। রাতের অলৌকিক আলো-ছায়ার খেলাও যে চাঁদ এর কারণেই ঘটে থাকে এটাও মানতে বাধ্য করবে পৃথিবীবাসীকে। এছাড়াও বহু জীবের জীবন ধারণও চলে চাঁদ এর উপস্থিতিতে।
কিন্তু ধরে নেওয়া যাক, কোনও একদিন দেখা গেল চাঁদ সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবীর আকাশ থেকে। কেমন হবে সেই দিনগুলি? ভাবতে অবাকই লাগবে হয়তো। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণা সেই রকমই একটি ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। কারণ তাঁরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ পেয়েছেন, চাঁদ প্রায় প্রতিদিনই একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিচ্ছেদ ঘটছে মা ও ছেলের।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, অ্যাপোলো মিশনের সময় চাঁদ এর বুকে কয়েকটা রিফ্লেক্টার বসিয়েছিলেন মহাকাশচারীরা। সম্প্রতি তার ওপর লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করে তাঁরা বুঝতে পারছেন, চাঁদ সত্যিই ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে পৃথিবীর থেকে। এই দূরে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে তাঁরা ‘লুনার রিশেসন’ বলেছেন। এক্ষেত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, চাঁদ এর এই দূরে সরে যাওয়ার হার বর্তমানে বছরে প্রায় ১.৫ ইঞ্চি বা ৩.৮ সেমি।
যদিও এই লুনার রিশেসন আজকের প্রক্রিয়া নয়, বহু কোটি বছর পূর্ব থেকেই ঘটে চলেছে। ৩২০ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবী থেকে চাঁদ এর দূরত্ব যেখানে ছিল প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে সেই দূরত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটারে। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে বলা যায়, যে যুগে সমুদ্রের পরিবেশে সবে জীবনের উদ্ভব ঘটতে শুরু করেছিল, সেই সময়ে রাতের চাঁদ ছিল অনেক বেশি বড় ও উজ্জ্বল।
কিন্তু কেন এই চাঁদ ক্রমশ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর জন্য এক কথায় জোয়ার-ভাঁটাকে দায়ী করেছেন। পৃথিবীতে চাঁদের আকর্ষণেই মূলত তৈরি হয় জোয়ার-ভাঁটা। তাঁরা জানাচ্ছেন, জোয়ারের সময় পৃথিবীর ঘূর্ণন কিছুটা হ্রাস পায়। তাই চাঁদ এ তৈরি হয় কৌণিক ভরবেগ। চাঁদ পৃথিবীর যেদিকে অবস্থান করে অভিকর্ষের টানে সেদিকে একবার জোয়ার তৈরি হয়। আবার বিপরীত দিকে চাঁদের অভিকর্ষ না থাকার জন্যেও আর একবার জোয়ারের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সমুদ্রের জলে জোয়ারের ব্যাপারটি ঘটে মূলত চাঁদ এর কক্ষপথকে সামনে রেখে। এই সময় চাঁদ পৃথিবীকে কিছুটা তার পিছনের দিকে টেনে ধরে রাখে। ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন অনেকটা হ্রাস পেয়ে যায়। ফলে চাঁদ তার ওপরের কক্ষে সামান্য সরে যেতে বাধ্য হয়।
তবে চাঁদের এই দূরে সরে যাওয়া সবসময় সমান ছিল না। এই যেমন তুষার যুগে ছিল একেবারেই কম। কারণ সেসময় পৃথিবীর অধিকাংশ জল জমে বরফে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আবার বর্তমান সময়ে এই দূরে সরে যাওয়ার হার অনেকটাই বেশি। কারণ ক্রমশই মেরু অঞ্চল থেকে বরফ গলে জলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তবে কী কোনও এক সময় চাঁদ পুরোপুরি হারিয়ে যাবে পৃথিবীর আকাশ থেকে? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে অবশ্য স্পষ্ট কোনও উত্তর দিতে চাননি। তাঁরা শুধু জানিয়েছেন, চাঁদকে আটকে রাখতে পারে মানুষই। পৃথিবীতে কার্বনের হার কমিয়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলনের হারকে হ্রাস করালে জোয়ার-ভাঁটাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ জমাট বরফই পারে জোয়ারকে চেপে রাখতে। তখন চাঁদ এর দূরে সরে যাওয়ার গতিও কমতে থাকবে নিঃসন্দেহে।