বল্লভপুর গ্রামের রাইপাড়া ও দাসপাড়ায় সবচেয়ে বেশি কেশে দিয়ে তৈরি ঘাস শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এখানকার মহিলারা সময় মতো কাশগুল্ম কোপাই নদীর চর থেকে লম্বালম্বি মাপে কেটে নিয়ে আসেন বাড়িতে। এরপর কেশেগুলো রোদে শুকিয়ে নিপুণ বুনন দিয়ে বিভিন্ন ধরণের শৈল্পিক আকারে তৈরি করেন।
শান্তিনিকেতন থেকে অনতি দূরে ছোট্ট, সুন্দর ও সুবজঘেরা গ্রাম বল্লভপুর। এই বল্লভপুর গ্রামকে কুটির শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান বললেও ভুল বলা হয় না। কারণ শান্তিনিকতেন ঘরনার বাটিক, চর্ম, কাঁথা স্টিচ সহ বিভিন্ন কুটির শিল্প গড়ে উঠছে এই গ্রামটিকে কেন্দ্র করে। এই সমস্ত কুটির শিল্পের সমাহারের মাঝে ধীরে ধীরে জনমানসে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে উদীয়মান ঘাস শিল্প। তবে এই বল্লভপুর অঞ্চলে কাঁথাস্টিচ, বাটিক, চর্ম শিল্প ব্যাপকভাবে সুনাম অর্জন করলেও ঘাস শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীর কদর এখনও অনেকটাই কম।
শিল্পের কাঁচামালের যোগান
বল্লভপুর গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে কোপাই বা শাল নদী। এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল ঘাস তাই এই নদীর ধার থেকে সংগ্রহ করা হয় যথেচ্ছ পরিমাণে। কোপাই নদীর বুকে যততত্র গজিয়ে ওঠা কাশফুলের ঘাস বা কেশে ঘাসকে উপকরণ বানিয়ে অনন্যা সুন্দর হস্তশিল্প সামগ্রী বানিয়ে স্বনির্ভর হতে পেরেছেন এই গ্রামের ৩০-৪০ জন মহিলা।
বীরভূমে অন্য ঘাস শিল্পের অভাব
নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষেরা সাধরণত নদীর চরে সবজি চাষ বা মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সেক্ষেত্রে এই ঘাস শিল্পের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ অন্যতম একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলে বাবুই, সাবাই, ভার্টিভার জাতীয় ঘাসকে কুটির শিল্পের উপকরণ বানিয়ে আয়ের সুযোগ পান স্থানীয়রা। বীরভূম জেলায় তেমন জাতের ঘাস তুলনামূলক খুবই কম পাওয়া যায়। কিন্তু এই জেলার নদীগুলি প্রায় সারা বছরই ভরে থাকে কেশে ঘাসের ঝোপে। আর তাকেই কেন্দ্র করে বল্লভপুর গ্রামে গড়ে উঠেছে এই ঘাস দিয়ে নির্মিত হস্তশিল্প। গ্রামের মহিলারা এই শিল্পকে কেন্দ্র করে হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী এবং দেখিয়েছেন নতুন কর্মসংস্থানের দিশা।
ঘাস শিল্প সামগ্রী
বল্লভপুর গ্রামের রাইপাড়া ও দাসপাড়ায় সবচেয়ে বেশি কেশে দিয়ে তৈরি ঘাস শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এখানকার মহিলারা সময় মতো কাশগুল্ম কোপাই নদীর চর থেকে লম্বালম্বি মাপে কেটে নিয়ে আসেন বাড়িতে। এরপর কেশেগুলো রোদে শুকিয়ে নিপুণ বুনন দিয়ে বিভিন্ন ধরণের শৈল্পিক আকারে তৈরি করেন। তা দিয়ে তৈরি হয় ফুলের সাজি, সবজি-ফল রাখার ঝুড়ি, ফুলদানি, কলমদানি, লক্ষীর ভাঁড়, চায়ের ট্রে, গয়নার বাক্স থেকে গৃহসজ্জার হরেকরকম দৃষ্টিনন্দন হস্তশিল্প সামগ্রী।
ঘাস শিল্প সামগ্রীর কদর
স্থানীয় ও বহিরাগত মানুষের কাছে এই রকম পরিবেশ বান্ধব ঘাস দিয়ে নির্মিত হস্তশিল্প সামগ্রীর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে শান্তিনিকেতন ও ‘আমার কুটির’-এ বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে এই ঘাসের শিল্প সামগ্রীর কদর রয়েছে অনেক বেশি। বিপনন ব্যবস্থার অভাবে এই উদীয়মান ঘাস শিল্প যাতে হারিয়ে না যায় এবং যাতে সহজে পর্যটকদের নজরে আসে সেজন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে আমার কুটির সোসাইটি ফর রুরাল ডেভলপমেন্ট সংস্থা। আমার কুটিরের শোরুমে বিভিন্ন হস্তশিল্পের সঙ্গে স্থান পেয়েছে এই ঘাস দিয়ে নির্মিত একাধিক হস্তশিল্প সামগ্রী।
শিল্পীদের বক্তব্য
এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত পিঙ্কি রাই জানালেন যে, “আমরা বিগত ২০০০ সাল থেকে কেশের তৈরী হস্তশিল্প সামগ্রী আমার কুটিরে দিয়ে আসছি। আমার কুটির ছাড়াও কর্মতীর্থ ও খোয়াইয়ের হাটেও ঘাসের তৈরি সামগ্রীর ভালই বাজার পাওয়া যায়।”
রাইপাড়া ও দাসপাড়ার মহিলাদের কাছ থেকে জানা গেল, এই হস্তশিল্প তৈরী করতে শ্রমনৈপুন্য ও কৌশলের প্রয়োজন। খুব ধৈয্য ধরে একটি টেকসই ঘাসের হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরি হয়। তবে এই শিল্পে পুঁজি অন্যান্য কুটির শিল্পের তুলনায় অনেকটাই কম লাগে। সাধারণত চৈত্র-জ্যৈষ্ঠ মাসে নিজেরাই নদীর চর থেকে কাশ কেটে বাড়িতে নিয়ে আসেন মহিলারা। অনেকে আবার এর জন্য মুনিশ বা শ্রমিকও ভাড়া করে থাকেন। এরপর সারাবছর এই কেশে দিয়ে তৈরী হয় বিভিন্ন ধরণের শৌখিন সামগ্রী।
দাসপাড়ার লীলা রায় জানালেন, “আমি বিগত ৩৫ বছর ধরে এই ঘাস দিয়ে নির্মিত হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। এই শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য খরচ প্রায় হয় না বললেই চলে। তবে কেশে ও খেজুর পাতা সংগ্রহ করতে পরিশ্রম করতে হয়। বৈশাখ মাসের তীব্র গরমে কেশের বনে ঢুকে কেশে কাটা খুব কষ্টকর।”
‘আমার কুটির’-এর ভূমিকা
রাইপাড়ার নাগিনা রাই, মঞ্জু রাই, ভালোশ্রী রাইরা জানালেন, “আমাদের বানানো ঘাসের হস্তশিল্প সামগ্রীর প্রধান বাজার বলতে আমার কুটির। আমাদের এই পাড়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ঘাসের হস্তশিল্প তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। যার অধিকাংশই আসে আমার কুটির সহযোগিতায়। প্রথমে গৃহস্থ্যের প্রয়োজনে আমরা কেশে দিয়ে জিনিস তৈরি করতাম। পরে আমার কুটিরের সৌজন্যে আমাদের এই শিল্প ব্যবসায়িক আওতায় আসে। আমার কুটিরের জন্যেই আজ ঘাস শিল্প বহিরাগতদের কাছে বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে।”