Friday, November 8, 2024

কবি ও কবিতা : সুজিত অধিকারী, বোধ ও বিষাদ মননের এক কবি

- Advertisement -

কবি সুজিত অধিকারী, জীবদ্দশায় যার একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ “পুনর্জন্ম অথবা গান” প্রকাশ পায়। যদিও প্রথম বইটি পড়ার সৌভাগ্য আমার এখনও হয়নি। তথাপি, মৃত্যু-পরবর্তী প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থ পড়ে কবি সুজিত অধিকারী র কাব্যভুবন সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা পাওয়াই যায়। আর সেখান থেকেই আমার এ লেখার জন্ম।

সুজিত অধিকারী
কবি সুজিত অধিকারী

পৃথিবীতে যদি জটিলতম শিল্প বলে কিছু থাকে তা হচ্ছে ‘কবিতা’। এরকমটা আমার মনে হয়। কেন না, কবিতার কোনও নির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই। ভিন্ন ভিন্ন কবির হাতে তা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ধরা পড়ে। আবার; ভালো কবিতা, খারাপ কবিতা – এসব নিয়েও বিতর্ক কম নয়। তাহলে কবিতাকে পরিমাপ করবই বা কি করে? এখানেই আমার যেটা মনে হয়, কবিতার ভিতর একটা সূক্ষ্ম আবেদন থাকা চাই, তা সে যেমনভাবেই লেখা হোক। কবিতা তার ভিতর দিয়ে এমন এক সূক্ষ্ম বিদ্যুৎ পরিবহন করবে, যা পাঠককে একটু হলেও ঝাঁকুনি দিয়ে তুলবে।

এবার প্রসঙ্গত কেউ কেউ দাবি তুলতেই পারেন, এই ‘ঝাঁকুনি’ বিষয়টিও আপেক্ষিক। ঠিকই তো। একেক জন পাঠক একেক রকম কবিতায় তাঁর ঈশ্বর খুঁজে পান। ঠিক এই ভিন্নতাগুলির কারণেই বিশ্বসাহিত্যে আজ কতগুলো ইজমের জন্ম হয়েছে। বিশেষ করে কবিতার রূপ, বৈশিষ্ট্য,  বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য, বিধেয়, ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে কবিতায় Romanticism, Realism, Surrealism, Structuralism, Modernism, Ultra-modernism ইত্যাদি ইজম এবং হাংরির মতো আন্দোলন উঠে এসেছে। তবে যত-ই ইজম উঠে আসুক না কেন, কবিতার যে সূক্ষ্ম আবেদনের কথা আমি বলছি, সেখানে দুটি বিষয়ই কাজ করে – স্বতস্ফূর্ত উদগিরণ এবং অস্বতস্ফূর্ত বা নির্মাণনির্ভর উদগিরণ।

অস্বতস্ফূর্ত বা নির্মাণনির্ভর উদগিরণে কবি নানান রকম কৌশল আয়ত্ত করতে পারেন। এখানে কবিতা যেমন সহজবোধ্য হতে পারে, তেমনি দুর্বোধ্যও হতে পারে। কিন্তু যাইহোক না কেন, এই ধরণের লেখা উদ্দেশ্যমূলক হয়ে থাকে (পাঠক, আমি কোনও ইতিবাচক বা নেতিবাচক বিশ্লেষণে যাচ্ছি না)। অপরপক্ষে, স্বতস্ফূর্ত উদগিরণে কবি একটি মাধ্যম মাত্র। কবিতা এখানে নিজে থেকেই তার রূপ ধারণ করে, নিজে থেকেই প্রয়োজনীয় শব্দটুকু বহন করে। এবং সর্বোপরি, এই ধরণের কবিতায় কবিকে অন্য কিছুর প্রতি দায়বদ্ধ হতে দেখা যায় না। কবি শুধু নিজের ভিতর জারিত হওয়া আন্দোলনের প্রতিই দায়বদ্ধ থাকেন। যার প্রকৃত উদাহরণস্বরূপ জীবনানন্দের নাম বলতে আমি বাধ্য। আর “ডাউন ট্রেনের কামড়া”, “মন খারাপের অনুচ্ছেদ” এবং “দীর্ঘ ভাঙনের পর আমি আর নদী” পড়ার পর কবি সুজিত অধিকারী কেও ঠিক ক্যাটেগরিতেই আমার ইনক্লুড করতে ইচ্ছা হয়।

কবি সুজিত অধিকারী, জীবদ্দশায় যার একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ “পুনর্জন্ম অথবা গান” প্রকাশ পায়। যদিও প্রথম বইটি পড়ার সৌভাগ্য আমার এখনও হয়নি। তথাপি, মৃত্যু-পরবর্তী প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থ পড়ে কবি সুজিত অধিকারী র কাব্যভুবন সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা পাওয়াই যায়। আর সেখান থেকেই আমার এ লেখার জন্ম। সুজিত অধিকারী র কবিতা কিছু হৃদয়গ্রাহী ব্যথা ও ছবির কোলাজ। যে বিষয়টা সবচেয়ে ভালো লাগে, কবিতাকে তিনি কখনওই ভারাক্রান্ত করে তোলেননি। স্বল্প ও নিঁখুত শব্দচয়নে ওঁর কবিতা পৌঁছে যায় এক অন্য মাত্রায়। আবার, আলো-আঁধারি বহুস্তরও ভেসে ওঠে। যেমন – ‘বুকের ভিতর ছয় ঋতু / আমি ঋতুমতী নদীর মতো / কখনো কখনো কেঁপে উঠি, দুলে উঠি / কখনো শীতের কাপে ঘুম, চায়ের কাপে ঠোঁট রাখি / আমার পাঁজার কাশফুল ফোটে, চোখে মেঘকন্যা / পরিযায়ী পাখি আসে, মেঘকন্যা পোশাক বদল করে / এইসব কবেকার কথা, কবেকার বর্ণমালা… / আমি নীরবে পড়ি – / বুকে কত আন্দোলন, এ বুক যেন ঋতুমতী নদী’।

- Advertisement -

আসলে পাঠক, স্বীকার্য হবে কিনা জানি না, প্রকৃত কবিতা লেখার জন্য কোথাও না কোথাও একটা যন্ত্রণাবিদ্ধ হাহাকার থাকা চাই, পাশাপাশি থাকা চাই জীবনকে তার সূক্ষ্মতম দৃষ্টি দিয়ে দেখার মতো চোখ ও বোঝার মতো বোধ, যে চোখ ও বোধ একজন কবিকে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক করে দাঁড় করিয়ে রাখে। আর এই চোখ ও বোধ নিয়ে কবি সুজিত  যেন জন্মগত কর্তৃত্বের “অধিকারী”। নইলে – ১) ‘যখন ভেতর দগ্ধ হয়, আকাশের দিকে তাকাই / কিছু উত্তর পেয়ে যাই, কিছু পাই না / ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে তোমাকে খনন করি / উঠে আসে গভীর কিছু পরামর্শ / কোনো প্রিয় নারীর আঙুলে প্রথম স্পর্শের মতো / উঠে আসে অন্ধকার থেকে কিছু আলো’; ২) ‘আমার ডাকবাক্সে দুঃখের অসংখ্য চিঠি / আমি রোজ ইচ্ছামৃত্যু বহন করি / আমার সমস্ত অহংলিপি অশ্রুলিপি হয়’; ৩) ‘ভালোবাসার মানুষ এখনও আছে / যার জন্য বেঁচে থাকি বহুকাল / তার মৃত্যু হলে ফুলের জন্ম হয়’; ৪) ‘আমি তো উদ্ভিদ সম্পর্কে আছি / পাখি উড়ে যায় চোখে চোখে / রাত্রি ঝরে / দু’একটি পালক আজ ঘুমের পাশে’; ৫) ‘আমার দুঃখগুলি আমারই মনের মতো / আর মন – সে তো বামুন বাড়ির ছোট মেয়ে নন্দিনী / যার শেষ নেই, শুধু শুরু আছে’; কিংবা ৬) ‘গ্রামের মতো ভাঙন, শহরের মতো ঘিঞ্জি / শাশ্বত, এক বিরহ কাছে আসে প্রতিদিন’ – ইত্যাদি এ জাতীয় অজস্র পঙক্তি, যা আপাতসহজ মনে হলেও, লিখে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়।

সুজিত অধিকারী যখন লেখেন, ‘মধ্যরাতে কবিতার চিবুক ছুঁয়ে আকাশ দেখি / মন শান্ত হয়, পর্ণমোচী বৃক্ষের মতো গা ঝেড়ে উঠি / যেন একটি পাখি গা থেকে জ্যোতস্না ঝরাচ্ছে’। তখন এ জাতীয় পঙক্তি পড়ার পর T.S. Eliot-কে মনে পড়ে। ১৯৯২ সালে “The Sacred  Wood” গ্রন্থে “Tradition and the Individual Talent” প্রবন্ধে Eliot লিখেছিলেন, ‘Poetry is not a turning loose of emotion but an escape from emotion; it is not the expression of personality, but an escape from personality. But, of course, only those who have personality and emotions know what it means to want to escape from these things.’। সুজিত অধিকারীর কবিতার ছত্রে ছত্রে যেন এই বক্তব্যেরই প্রতিফলন দেখতে পাই, যেখানে কবিতাকে তিনি আবেগের আজ্ঞাবহ করে তোলেননি। বরং আবেগ ও ব্যক্তিত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে জীবনের কোনও গূঢ় সত্যের দিকে নিজেকে চালনা করেছেন।

আসলে, কবিতা তো এই গূঢ় সত্যকেই অনুসন্ধান করতে চায় সব সময়। যেখানে কবি ও কবিতা পরস্পরের মুখোমুখি হলে আর কোনও দ্বিতীয় সত্তার উপস্থিতি থাকে না। আবার, এই বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও ভীষণ ভুল হবে যে, সুজিত অধিকারী র কবিতা হৃদয়ের কথা বলতে বলতে চমৎকার কতগুলো ছবি বা দৃশ্যকল্প তৈরি করে ফেলে – পর্ণমোচী বৃক্ষের মতো গা ঝেড়ে ফেলা এবং একটি পাখির গা থেকে জ্যোৎস্না ঝরানোর মধ্যে যে পবিত্র ইমেজ ফুটে ওঠে তা তাঁর কবিতার অন্যতম একটি সম্পদ। এছাড়া, ‘রঙিন টি-শার্ট পরা হাসিখুশি মেজাজ’, ‘লোকাল ট্রেনের হকারের মতো / প্রতিদিন নির্দিষ্ট পথে ভাবনা চলে’, ‘চিড়িয়াখানার মতো বন্দী আমাদের কতগুলো স্মৃতি’, ‘আমার রাতগুলি ক্রমশ ভাস্কর্যহীন হয়ে ওঠে’, ‘পারদের গায়ে বেদনার মুজরো’ ইত্যাদি পঙক্তিগুলোতে ফুটে ওঠা ছবি কথা বলে।

কবি সুজিত অধিকারী র জন্ম উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার এক জনবহুল গ্রাম নিশিগঞ্জে। মায়াঘেরা উত্তর-প্রকৃতির ছায়া এবং তার নিবিড় আঁকড়ে মোহনার দিকে ধাবিত মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে তাঁর কবি হয়ে ওঠা। স্বভাবতই, ওঁর কবিতায় এই মানুষগুলিরই কথা, এই মানুষগুলিরই মনের কথা। তাঁদের জীবনসংগ্রাম, প্রেম, সম্পর্ক, জটিল মনস্তত্ত্বই ওঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে। ব্যক্তিগত বিষাদ, স্বজন হারানোর যন্ত্রণার মধ্যে তিনি খুঁজে ফেরেন একটি অতিজাগতিক অস্তিত্বকে। যে অস্তিত্বের তাড়নায় জীবন সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মনে জেগে ওঠে কতগুলো প্রশ্ন – ‘এ তো ভালোবাসা নয়, মৃত্যুগামী কাম / দিনগত পাপক্ষয় / পাপ কি সত্যিই ক্ষয় হয় রাত্রির অনুশোচনায়? / নাকি তুসের আগুনের মতো ধিকিধিকি পোড়ে এ জীবন।’

যাইহোক, সুজিত অধিকারী র কবিতা নিয়ে বলতে গেলে আর একটি বিষয় বলতেই হয়। তা হল, তিনি সচেতনভাবেই বিশ্বাস করতেন, শিল্পীর কাজ কখনওই শিক্ষক হওয়া নয়, বরং শিল্পী শুধু তাঁর বোধ থেকে ছবি তুলে এনে নানান রঙে সাজিয়ে তাঁকে পরিবেশন করবেন। দর্শককে বিভিন্ন কোণ থেকে তা দেখাবেন এবং ভাবিয়ে তুলবেন। ওঁর কবিতা ঠিক এমনই। তিনি কখনওই পাঠককে চোখে আঙুল দিয়ে পৃথিবীর ভুলগুলোকে দেখাতে চাননি। বরং তাঁর কথা বলার ধরণ থেকে পাঠক স্বয়ং ভাবতে বাধ্য হন। কেন না, ‘আমি জানি সব বোধের একটা ঘনত্ব আছে।’ এই ঘনত্বের অনুসন্ধান কবি তাঁর প্রতিটি কবিতায় খুব সন্তর্পণে রেখে যান। এমনকি কবি সুজিত যেসব কবিতা লিখে গেছেন তার প্রত্যেকটার পিছনে একটা করে অন্ধকার লুকিয়ে থাকলেও, সেইসব অন্ধকারের ব্যাকরণও ছিল। যে ব্যাকরণ সুজিত অধিকারী কে আবহমান বাংলা কবিতার ছক-ভাঙা কবিদের একজন করে তোলে।

আমি দেখতে পাই, সুজিত অধিকারী একা। ভীষণ একা। আর ওঁর এই একাকীত্ব কবিতায় ঈশ্বরীয় রূপ ধারণ করেছে। এখানে ব্যক্তি সুজিত প্রতিনিয়ত একা একা নিজেকে খুঁজেছেন কবিতার সুজিতের মধ্যে। এবং সেই পথ হাঁটাও সম্পূর্ণ একা এবং নির্জন রাস্তায়। তাই বলে তাঁর কবিতা মোটেও অন্ধকারের নয়, বরং অন্ধকারের মধ্যে আলোকোজ্জ্বল বাতিটির। কথা প্রসঙ্গে আমার আর একবার T.S. Eliot-কে টেনে আনতে ইচ্ছা করছে – ‘Genuine poetry can communicate before it is understood.’। যেমন ধরুণ, এই কবিতাটি – (ক্লান্তি) ‘প্রেম আর ভূগোল তো এক জিনিস নয় / যেখানে ডুব দিলে সারেগামাপা সুর ওঠে / শঙখ বাজে, পোড়া মন্দিরে ঘন্টা বাজে / আমি তো পুরোহিত / নিবেদন করি দেশ-কাল-প্রেম / যতই ভক্তি ভরে যজ্ঞে ঢালি ঘি / পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি আমার বুকে এসে বসে।’

পরিশেষে, আরও বহু কথা বাকি থেকে গেল, বহু বিষয় অনালোকিত, বহু কথা অনালোচিত রয়ে গেল। সীমিত পরিসরে আপাতত এটুকুই বলে যাই, ‘কত ভাষা বুকের ভেতর দোতারা হয়ে গেছে।’ এই দোতারার তারে কবি সুজিত অধিকারী ‘প্রতিটি রাত কবিতার কাছে সমর্পণ করেও / না পাওয়ার অভিমানে আত্মঘাতী’ হন এবং ‘মনখারাপের এক ঘূর্ণিতে তলিয়ে’ যেতে যেতে ‘বাঁচার জন্য খাতায় নির্জনতা’ আঁকেন। তবুও শেষ পর্যন্ত মৃত্যু নামক চির-নির্জনতার দেশে থেকে জানান দেন ‘সত্যিকারের কোনও মানুষের মৃত্যু হলে / ফুলের জন্ম হয়।’ আর সেই বহুদূর বিস্তৃত, ছড়িয়ে পড়া ফুলের গন্ধ নিয়ে আমরা আজও কবিকে স্মরণ করি।

- Advertisement -

এই রকম আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সাম্প্রতিক খবর