গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -রের দায়িত্ব চলে যায় বোলপুর-সরুল অঞ্চলের নীল কুঠির মালিক জন চিফের হাতে। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ব্যবসায়ী। তাঁর হাত ধরেই গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -টির অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। তিনি প্রথমেই জোর দেন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দিকে। এর জন্য চিফ সাহেব সিউড়ি থেকে সুরুল, বর্ধমান থেকে গুনুটিয়া এবং সরুল থেকে কাটোয়া পর্যন্ত রাস্তা তৈরি ও সংস্কার করার ব্যবস্থা করেন।
বীরভূম জেলার আমড়া গ্রামে জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এক সময়ের বিখ্যাত রেশম কুঠি -টি। স্থানীয়রা এটিকে ‘নীল কুঠি’ বললেও, আদতে এটি একটি রেশম কুঠি। কারণ ঐতিহাসিক দিক থেকে এই অঞ্চল বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নীল চাষের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গুনুটিয়ার খুব কাছে অবস্থান করায় খাতায় কলমে এটি ‘গুনুটিয়ার রেশম কুঠি’ নামেই পরিচিত হয়ে রয়েছে। এর ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মূয়রাক্ষী নদী। বর্ষার মরশুম ছাড়া অন্য সময়ে এই নদীতে প্রায় জল থাকে না বললেই চলে।
মূয়রাক্ষী নদীর অনুকূল আবহাওয়া ও নাব্যতাকে কাজে লাগিয়ে ১৭৭৫ সাল নাগাদ ব্রিটিশ বণিক এডওয়ার্ড হে গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -টি নির্মাণ করেছিলেন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের সময় বীরভূম রেশম বস্ত্রে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল। এখানকার নির্মিত রেশম সে সময় পৌঁছে যেত সমগ্র ভারতের পাশাপাশি সুদূর পাশ্চাত্য দেশগুলিতেও।
পরে ১৭৮৫ সাল নাগাদ বণিক জেমস ফ্রুসাড মাত্র কুড়ি হাজার টাকার বিনিময়ে এডওয়ার্ড এর কাছ থেকে গুনুটিয়ার এই রেশম কুঠি -টি কিনে নেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি জঙ্গল পরিষ্কার করে এর পরিধি ব্যাপ্ত করেন। এরপর তিনি স্থানীয় দুঃস্থ চাষিদের তুঁত চাষ করতে দাদন (চাষিদের অগ্রিম অর্থ প্রদান) দেওয়া শুরু করেন। তাঁর হাত ধরেই এখানে আসে রেশম কারখানার ইতালীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি। কাঁচা রেশম উৎপাদনের জন্য ফ্রুর্সাড সাহেব প্রায় ২০০টি লৌহভান্ড নির্মাণ করেছিলেন এখানে।
কিন্তু ভাগ্য তাঁকে সঙ্গ দেয়নি। দুর্ভাগ্যবশত সেবার ময়ূরাক্ষী নদীর প্রবল বন্যা তাঁর শিল্পোৎদ্যোগে কঠিন আঘাত হানে। পরে কুঠির সংস্কারের জন্য রাজনগরের নবাব মহম্মদ উলজামান এর সাহায্যপ্রার্থী হন তিনি। নবাব ফ্রুসাড সাহেবকে ১২ বছরের চুক্তিতে ২৫০০ বিঘা জমির বন্দোবস্ত করে দেন। কিন্তু প্রতিবছর উচ্চ হারে খাজানা মেটাতে সাহেব ব্যর্থ হন। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে তিনি প্রচুর ঋণের বোঝায় জড়িয়ে পড়েন সে সময়। ১৮০৭ সালে রহস্যজনকভাবে গুনুটিয়ার এই রেশম কুঠি -রেই তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়।
এরপর গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -রের দায়িত্ব চলে যায় বোলপুর-সরুল অঞ্চলের নীল কুঠির মালিক জন চিফের হাতে। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ব্যবসায়ী। তাঁর হাত ধরেই গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -টির অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। তিনি প্রথমেই জোর দেন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দিকে। এর জন্য চিফ সাহেব সিউড়ি থেকে সুরুল, বর্ধমান থেকে গুনুটিয়া এবং সরুল থেকে কাটোয়া পর্যন্ত রাস্তা তৈরি ও সংস্কার করার ব্যবস্থা করেন। তাঁর সময়ে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -টি। একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, ১৮০৪ সাল নাগাদ যেখানে ফ্রুসার্ড সাহেবের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা, সেখানে চিফ সাহেব বিনিয়োগ করেছিলেন প্রায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। তাঁর সময়েই কুমারখালীর পর এই গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -টিই উৎপাদনের দিক থেকে ছিল রেশম শিল্পে সর্ববৃহৎ। ৪১ বছর রেসিডেন্ট পদে থাকাকালীন গুনটিয়ার রেশম কুঠি -তেই তিনি ১৮২৮ সাল নাগাদ ৬২ বছর বয়সে মারা যান। তাঁকে এখানেই সমাধি দেওয়া হয়েছে।
জন চিফের পর রেসিডেন্ট পদে বসেন শেক্সপিয়ার নামে আরও একজন সাহেব। ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে ছিলেন এখানকার। যদিও তাঁর সময়ে খুব একটা শ্রীবৃদ্ধি ঘটেনি গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -র ও রেশম শিল্পের। এরপর এই কুঠিরের দায়িত্ব চলে যায় বেঙ্গল সিল্ক কোম্পানির হাতে। মূলত এই সময় থেকেই রেশম শিল্পে মন্দা দেখা দিতে থাকে। রেশম চাষ করতেও উৎসাহ হারাতে থাকে ওই এলাকার চাষিরা।
বেঙ্গল সিল্ক কোম্পানি তাই বাধ্য হয় গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -টি পাঁচথুপি ও জজানের জমিদারদের কাছে বিক্রি করে দিতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৫ সালে জমিদারী প্রথার অবসান ঘটলে গুনুটিয়ার রেশম কুঠি -টি কিনে নেন চন্দ্রহাট গ্রামের বিনয়ভূষণ বন্দোপাধ্যায় ও ভোগপুর গ্রামের জটিলচন্দ্র ঘোষ। পরিণত হয় ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। যা আজও এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবেই রয়ে গিয়েছে।
ভাবতে অবাক লাগে, ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো গুনুটিয়ার এই রেশম কুঠি থেকে যেখানে এককালে রেশম শিল্পের কাঁচামাল পৌঁছে যেত ইংল্যান্ড সহ পাশ্চত্য দেশগুলোতে। আজ সেই কুঠি প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে পড়ে রয়েছে। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ভগ্নপ্রায় দালান, কারখানা আর চিমনির অংশগুলি। আর তার মাঝে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে অবহেলায় ও অযত্নে পড়ে রয়েছে চিফ সাহেবর সমাধি। ইতিহাসের এক অজানা হতাশা যেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে এখানকার বাতাসে বাতাসে। স্থানীয়দের দাবি, ঐতিহাসিক এই স্থানটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। তাতে মূয়রাক্ষীর নিবিড় এই শান্ত পরিবেশে গ্রাম্যপর্যটনের এক নতুন দিক খুলে যেতে পারে।