এখন বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে আলু। আলু যেন আজ বাঙালির প্রাণ। রান্নার প্রতিটি পদে মিশে রয়েছে এই আলু। মূল্য যত বেশিই হোক, আলু অবশ্যই চায় বাঙালির। অথচ ভাবতে অবাক লাগে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে এই আলু ছড়িয়ে পড়া ছিল রীতিমতো ঐতিহাসিক ঘটনা।
আলু বিষয়ে এখন ক্রেতাদের প্রায় মাথায় রাখার অবস্থা। অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে এবছর বাংলা মুলুকে আলু চাষ তেমনভাবে করতে পারেনি চাষিরা। তাই আলু চাষের মরশুম থেকেই এই সবজির দাম একেবারেই কমেনি। বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে। সবজি বাজারে গড়ে এর মূল্য এখন ৩৫-৩৭ টাকা দর প্রতি কেজির। এই দর আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
তা সত্ত্বেও আলু অবশ্যই কিনতে হবে ক্রেতাদের। কারণ আলু যে এখন কতটা প্রয়োজনীয় সবজি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতীয় উপমহাদেশে যে কোনও পদে আলু এখন অবশ্যই চায়। আলু ছাড়া ভারতীয়রা যেন খাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। ব্যতিক্রম কয়েকটি বাদে যে কোনও রকম পদে আলু র ব্যবহার রয়েছে।
কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হয়, প্রায় চারশো বছর আগেও ভারতীয় উপমহাদেশ সহ গোটা এশিয়া জুড়ে আলু র চিহ্নমাত্র ছিল না। আলু কেমন জিনিস তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল পর্তুগিজরা। ইতিহাস বলছে সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজ নাবিকরা প্রথম ভারতে আলু নিয়ে আসে। তারা সমুদ্রের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার সময় নিজেদের পেট ভরাতে আলু র উপর ভরসা রাখত বেশি। আলু সহজে নষ্ট হয় না। তাই দীর্ঘদিন একে সঞ্চয় করে রাখাও সম্ভব।
বলা বাহুল্য, যদি কেউ ধারণা করে থাকে আলু ইউরোপের নিজস্ব ফসল, তাহলেও ভুল করা হবে। কারণ এই আলু ও কিন্তু ইউরোপে তখন খুব বেশিদিন আসেনি। ইউরোপে আলু র আগমন ঘটে স্প্যানিশদের হাত ধরে। পঞ্চদশ শতকে স্প্যানিশরা দক্ষিণ আমেরিকা গিয়েছিল সাম্রাজ্য বাড়াতে। সে সময় তারা পেরু ও বলিভিয়াতে আলু চাষ করতে দেখে। এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, আলু চাষ প্রথম শুরু হয়েছিল পেরুতে। এখানকার আদিবাসীরা নিজেদের খাওয়া ও বিভিন্ন রকমের ওষুধ তৈরির জন্য এই ফসলের চাষ করত।
স্প্যানিশরা মূলত দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে এসেছিল সোনার খোঁজ করতে। তাদের হাতে ইনকা সভ্যতার পতন ঘটে। কিন্তু সোনার খোঁজ তারা পায়নি। তার পরিবর্তে কামাটা বা বাটাটা নামের এমন একটি বস্তুর খোঁজ পেয়েছিল, যা সমগ্র বিশ্বের খাদ্য তালিকা বদলে দিয়েছিল। পেরুর স্থানীয় ভাষায় আলু কে বলা হয় কামাটা বা বাটাটা। স্প্যানিশরা ততদিনে জেনে গিয়েছে আলু র ব্যবহার ও গুনাগুন সম্পর্কে। ১৫৬৫ সাল নাগাদ জাহাজ ভরে সেই আলু ই নিয়ে আসে নিজেদের দেশে। পরে স্প্যানিশদের হাত ধরেই কামাটা বা বাটাটা পরিবর্তিত হয় পটেটো-তে। স্প্যানিশদের মাধ্যমেই প্রথমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এই পটেটো বা বাংলায় আলু।
তবে ইউরোপে অতি সহজে এই আলু কে গ্রহণ করতে চায়নি সাধারণ মানুষ। ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, আলু নাকি কালো চামড়ার আদিবাসীদের খাবার। তাছাড়া প্রথম দিকে আলু কে দেখতে ছিল বেশ কদাকার, অনেকটা শিকড়ের মতো। তাই সহজেই বর্ণবিদ্বেষ লেগে যায় আলু র গায়ে। এমনকি ১৭৪৮-১৭৭২ সাল পর্যন্ত আলু নিষিদ্ধ ছিল ফ্রান্সে। রাশিয়ানরাও আলু কে দীর্ঘদিন ভালো চোখে দেখেনি। পরে বিভিন্ন সময়ে আলুর গুনাগুন, উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তার দিক বিবেচনা করে একে গ্রহণ করেছে ইউরোপীয়রা।
এবার ফিরে আসা যাক ভারতের প্রসঙ্গে। আগেই বলা হয়েছে ভারতে আলু র আবির্ভাব ঘটেছে পর্তুগিজদের মাধ্যমে। পর্তুগীজ নাবিকরা সপ্তদশ শতকের দিকে কেরালার কালিকট বন্দরে প্রথম আলু নিয়ে আসে। তাদের পাশাপাশি স্থানীয় শ্রমিকরাও আলু পছন্দ করতে শুরু করে।
পরে ইংরেজদের হাত ধরে সমগ্র ভারতে আলু ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৭২-১৭৮৫ সাল পর্যন্ত গভর্নর ওয়ারেন হেস্ট্রিংস মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে আলু চাষে উদ্যোগ নেন। তার ধারণা ছিল, ভারত থেকে এই আলু ইউরোপে বিক্রি করবেন। পরে ভারতের উত্তরাখণ্ড ও মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে আলু চাষ শুরু হয়। তবে অনেক পরে অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বাংলায় প্রথম আলু নিয়ে আসে ব্রিটিশরা।
এই সময়ে কলকাতার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে প্রথম আলু চাষে উদ্যোগ নেই ব্রিটিশরা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার খাদ্য তালিকায় প্রবেশ করে আলু। পেরুতে চাষের জমিকে বলা হয় আলু, তাই পটেটো বাংলায় হয়ে গেল আলু।
তবে ঐতিহাসিকদের ধারণা, বাংলায় প্রথম আলু নিয়ে আসে লখনউ এর নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্। তার ১৮৫৬ সাল থেকে কলকাতায় নির্বাসিত থাকার সময়ে বিরিয়ানিতে আলু মেশানো শুরু হয়।
এখন বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে আলু। আলু যেন আজ বাঙালির প্রাণ। রান্নার প্রতিটি পদে মিশে রয়েছে এই আলু। মূল্য যত বেশিই হোক, আলু অবশ্যই চায় বাঙালির। অথচ ভাবতে অবাক লাগে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে এই আলু ছড়িয়ে পড়া ছিল রীতিমতো ঐতিহাসিক ঘটনা।