ব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো : এখানে সংস্কৃতের বদলে মন্ত্রোচ্চারণ হয় কোঁড়া ভাষায়

Advertisement
কোঁড়া সম্প্রদায়ের এই দুর্গাপুজো বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো হলেও এখানে মিশে রয়েছে আদিবাসী ভাবধারা। পুজো হয় চার দিন (সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী) ধরেই। এখানে হোম, যজ্ঞ, সন্ধ্যারতি, কলাবউ স্নান, ঘট আনয়ন এসবই হয় হিন্দু মতে। এমনকি অষ্টমী পুজোয় পাঁঠাবলিরও বন্দোবস্ত থাকে। তবে ব্যতিক্রম এখানে মন্ত্রোচ্চারণে। সংস্কৃতের বদলে এই পুজোয় মন্ত্রোচ্চারণ হয় কোঁড়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা ও ঢঙে।
ব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো : এখানে সংস্কৃতের বদলে মন্ত্রোচ্চারণ হয় কোঁড়া ভাষায়

বিশ্বজিৎ ঘোষ : সুন্দিপুর কোঁড়া পাড়ায় এক অন্যরকম ব্যতিক্রমী ঢঙে দুর্গোৎসবের আয়োজন করে কোঁড়া আদিবাসী সম্প্রদায়।কোঁড়া মূলত ঢেঙড়, মাহালী, রাজবংশীর মতোই বঙ্গদেশের একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। তারা তাদের নিজস্ব কোঁড়া ভাষাতেই কথা বলে। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে খুব একটা মূর্তি পুজোর প্রচলন নেই। সেখানে সুন্দিপুরের এই কোঁড়া জনগোষ্ঠীর দুর্গাপুজো যেন অনেকটাই ব্যতিক্রমী ও সাহসী পদক্ষেপ।

কোঁড়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা অতীতে উত্তর আন্দামান দ্বীপের পূর্ব অংশে বসবাস করত। গ্রেট আন্দামানী জনগণের দশটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর এরা অন্যতম। এরা ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে কোঁড়াদের আবির্ভাব বিহার থেকে। পরে তারা নির্ভরশীল অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক ও হিন্দুদের সঙ্গে সংস্কৃতি বিকাশ গড়ে তুলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে, হিন্দুদের থেকে তারা দূরে নয়।

বীরভূম জেলার আমোদপুর থেকে চার কিলোমিটার পূর্ব দিকে সিউড়ি-লাভপুর সড়কে সুন্দিপুর গ্রামের মধ্যেই রয়েছে আর একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম, নাম কোঁড়াপাড়া। বর্তমানে এখানে প্রায় ৭০-৮০টি কোঁড়া পরিবার বসবাস করছে। প্রায় সকলেই চাষি বা দিনমজুর। এখানে দুর্গাপুজো করে থাকে কালীপদ কোঁড়া, বিজয় কোঁড়াদের পরিবার। এই পুজো হয় সম্পূর্ণভাবে আদিবাসী রীতিনীতি অনুসরণ করে। যা বাঙালিদের প্রচলিত মূল দুর্গাপুজো থেকে কিছুটা ব্যতিক্রমী।

কীভাবে এই পুজোর প্রচলন ঘটল? এব্যাপারে কালীপদ কোঁড়া জানালেন অনেক কিছুই। বহু বছর পূর্বে তাঁদের আদি বসতি ছিল আমজোড়া, রাণীশ্বর (বীরভূম-ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী) এলাকায়। মূলত সেখান থেকেই তাঁদের দুর্গা পুজোর সূচনা হয়েছিল। প্রয়াত অনন্ত কোঁড়া, গোকুল কোঁড়া তখন ঘট পুজোর মাধ্যমে মা দুর্গার আরাধনা করতেন। সেই রীতি আজও বর্তমান প্রজন্মের কোঁড়া সম্প্রদায় বহন করে চলেছে।

কালীপদ কোঁড়া আরও জানালেন, তাঁদের আদি নিবাস আমজোড়া, রাণীশ্বরের পরিবেশ ছিল রুক্ষ। মাটিও ছিল চাষের অনুপযোগী। তাই সেখানে চাষবাস খুব একটা হত না। খাদ্যের অভাব ছিল চরম। প্রচণ্ড কষ্ট করেই তাঁদের দিনযাপন করতে হত। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই সেই স্থান ত্যাগ করেন তাঁরা। চলে আসেন এই সুন্দিপুর অঞ্চলে। এখানেই তাঁরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

সুন্দিপুরে আসার পর অবশ্য বেশ কয়েক বছর তাঁদের দুর্গাপুজো বন্ধ ছিল। পরে এই পরিবারের কোনও এক সদস্যকে মা দুর্গা পুনরায় পুজো শুরু করার স্বপ্নাদেশ দেন। এরপর থেকে আবার শুরু হয় দুর্গাপুজো। তবে প্রথম ক’বছর ঘটেই হয়েছে পুজো। পরে গ্রামের প্রতিটি পরিবারের মঙ্গল কামনায় শুরু হয় পূর্ণাঙ্গ রূপে মায়ের মূর্তি পুজো। আর এই ভাবেই পুজো গড়িয়ে গেল ২৫ বছর। এখন কংক্রিটের মন্দির নির্মাণ হয়েছে পুজোর জন্য। এর আগে বাঁশ-কাপড়ের সুসজ্জিত প্যান্ডেল নির্মাণ করেই দুর্গার আরাধনা করা হত। অবশ্য এরও আগে ছিল তালপাতার ছাউনি দেওয়া মাটির মন্দির।

কোঁড়া সম্প্রদায়ের এই দুর্গাপুজো বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো হলেও এখানে মিশে রয়েছে আদিবাসী ভাবধারা। পুজো হয় চার দিন (সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী) ধরেই। এখানে হোম, যজ্ঞ, সন্ধ্যারতি, কলাবউ স্নান, ঘট আনয়ন এসবই হয় হিন্দু মতে। এমনকি অষ্টমী পুজোয় পাঁঠাবলিরও বন্দোবস্ত থাকে। তবে ব্যতিক্রম এখানে মন্ত্রোচ্চারণে। সংস্কৃতের বদলে এই পুজোয় মন্ত্রোচ্চারণ হয় কোঁড়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা ও ঢঙে। ব্যতিক্রম পৈতা ধারণের ক্ষেত্রেও। পুরোহিতেরা এখানে পৈতা ধারণ করেন মহাসপ্তমীতে। পুজো সম্পন্নের পর দশমীতে আবার পৈতা খুলে দুর্গার কাঠামোর উপর রেখে দেন। এই পুজোর বর্তমান পুরোহিত বিজয় কোঁড়া ও তাঁর সহকারী কালীপদ কোঁড়া।

কোঁড়াপাড়ার এই দুর্গা পুজো যেন এই কোঁড়া সম্প্রদায়ের অন্তরের সঙ্গে মিশে রয়েছে। পুজোর চারদিন সমগ্র কোঁড়াপাড়া তো বটেই, পার্শ্ববর্তী আদিবাসী অঞ্চলের সকলেই এখানে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসেন। যারা প্রায় সারা বছর কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন, তাঁরাও পুজোর এই চারদিন সামিল হতে গ্রামে ফিরে আসেন। এই চারদিনই চলে আদিবাসী সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষ্ঠান।

Advertisement
Previous articleব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো : মহানবমীতে শূকর বলির প্রথা রয়েছে এখানে
Next articleব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো : এখানে দেবী দুর্গার সঙ্গে পুজো পায় জয়া ও বিজয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here