ব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো : এখানে পুজো করা হয় নবপত্রিকা বাসিনী দুর্গার

Advertisement
দেবী অম্বিকা তাঁর গুরুভক্তি দেখে অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন এবং দর্শন দিয়ে তাঁকে প্রার্থিত বর চাওয়ার জন্য বললেন। এই সময় বিরুপাক্ষ একটি বড় প্রস্তরখণ্ডে বসে জপ করছিলেন। তিনি প্রার্থনা করলেন, যখন যেখানে তিনি জপ শুরু করবেন সেইখানেই যেন দেবী এই প্রস্তরখন্ডটি বয়ে নিয়ে যান। দেবী তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। অতঃপর বিরুপাক্ষ যেখানেই জপের জন্য বসতেন, সেইখানেই দেবী প্রস্তরখন্ডটি বয়ে নিয়ে যেতেন।
ব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো : এখানে পুজো করা হয় নবপত্রিকা বাসিনী দুর্গার

সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : সিউড়ি থেকে স্বল্প দূরত্বে চন্দ্রভাগা নদীর অদূরে রয়েছে সিঙ্গুর গ্রাম। গ্রামটি নেহাতই অখ্যাত। এইখানেই একসময় বাস করতেন মহাসাধক বিরুপাক্ষ দেব। তাঁর সময়কাল সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। তবে মনে করা হয় তিনি পাল যুগের একদম শেষ দিকে অথবা মুসলিম যুগসন্ধিকালে বর্তমান ছিলেন।

বিরুপাক্ষ ছিলেন মা দুর্গা তথা অম্বিকার উপাসক। কিন্তু দীর্ঘদিন সাধনা করার পরেও যখন তিনি অম্বিকার দর্শন লাভ করতে সমর্থ হলেন না, তখন তিনি এর কারণ জানতে চাইলেন দেবীর কাছে। দেবী অম্বিকা তাঁকে অপ্রকটিতভাবে জানালেন তাঁর গুরু প্রদত্ত মন্ত্র অশুদ্ধ। তিনি তাঁকে শুদ্ধ মন্ত্রটি দান করে তা জপ করার পরামর্শ দিলেন। এই ঘটনায় বিরুপাক্ষ অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি দেবীকে জানালেন, তাঁর গুরুদত্ত মন্ত্র অশুদ্ধ হলেও তিনি সেই মন্ত্রই জপ করে যাবেন। এতে যদি দেবী তাঁকে দর্শন না দেন, তাতেও তাঁর কিছু এসে যাবে না।

দেবী অম্বিকা তাঁর গুরুভক্তি দেখে অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন এবং দর্শন দিয়ে তাঁকে প্রার্থিত বর চাওয়ার জন্য বললেন। এই সময় বিরুপাক্ষ একটি বড় প্রস্তরখণ্ডে বসে জপ করছিলেন। তিনি প্রার্থনা করলেন, যখন যেখানে তিনি জপ শুরু করবেন সেইখানেই যেন দেবী এই প্রস্তরখন্ডটি বয়ে নিয়ে যান। দেবী তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। অতঃপর বিরুপাক্ষ যেখানেই জপের জন্য বসতেন সেইখানেই দেবী প্রস্তর খন্ডটি বয়ে নিয়ে যেতেন।

পরবর্তীকালে বিরুপাক্ষের পুত্র কবীন্দ্র ও তার পরিবার এই গ্রাম ত্যাগ করে দুর্গাপুরের নিকটবর্তী অঞ্চলে চলে যান। কথিত আছে, এই প্রস্তরখন্ডটি থেকেই রাঢ়েশ্বর শিব তৈরি হয়েছিল।


এখানে পুজো করা হয় নবপত্রিকা বাসিনী দুর্গার

যাইহোক, বিরুপাক্ষ প্রতিষ্ঠিত সেই প্রাচীন পুজো এখনও বর্তমান। কিংবদন্তি বলে, বিরুপাক্ষ সাধক কমলাকান্তের মত মৃণ্ময়ী মূর্তির পায়ে বেল কাঁটা ফুঁটিয়ে মূর্তি যে চিন্ময়ী তা দেখিয়েছিলেন। তারপর থেকে বিরুপাক্ষ তার বংশধরদের মূর্তি গড়ে পুজো করার ব্যাপারে নিষেধ করেন। নিষেধ থাকায় এখন আর মূর্তি গড়ে পুজো করা হয় না। পুজো করা হয় নবপত্রিকা বাসিনী দুর্গার। আশ্চর্যের বিষয় এই যে গ্রামে আরও অন্তত প্রাচীন দুটি পুজো রয়েছে সেখানেও কিন্তু মূর্তি গড়া হয় না। তবে সম্প্রতি একটি গজিয়ে ওঠা বারোয়ারি পুজোয় অবশ্য মূর্তি গড়ে পুজো করা হয়।

প্রাচীন দুর্গা মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। বর্তমান মন্দিরটি ষাটের দশকে নির্মাণ করিয়ে দেন আমার দাদু পানুড়িয়া গ্রামের সমাজসেবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্য প্রয়াত ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়। এই মন্দিরটিও বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরের সংলগ্ন রয়েছে একটি গোপাল মন্দির। প্রাচীন মন্দিরটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেখানেও একটি নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রামে বেশ কয়েকটি শিব মন্দির ছিল যেগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পুনরায় সেগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বিরুপাক্ষের প্রতিষ্ঠিত এই পুজো বীরভূমের প্রাচীন পুজোগুলির অন্যতম।

বর্তমানে নিত্যপুজা সহ দুর্গাপুজোটি চালাচ্ছেন বিরুপাক্ষের পরিবারের শ্রীযুক্ত উদয় ভট্টাচার্য্য এবং তাদের অন্যান্য শরিকরা। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই পুজো এখনও অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে।

Advertisement
Previous articleব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো : এখানে সন্ধিপুজোয় বাড়ির মেয়েরা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়
Next articleব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো : মহানবমীতে শূকর বলির প্রথা রয়েছে এখানে

1 COMMENT

  1. সোমনাথ বাবু বীরভূমের এক স্বল্প খ্যাত গ্ৰাম সিঙ্গুরের ব্যতিক্রমী দুর্গা পূজার ঐতিহাসিক সত্যকে তুলে ধরেছেন।
    ক্ষেত্রীয় গবেষক হিসেবে সোমনাথ বাবু অতি প্রাচীন এই ঘটনা
    জনদপ’নে তুলে ধরেছেন। সত্যের মুখোমুখি হয়ে অনেক তথ্য
    জানতে পারলাম। অপেক্ষায় থাকলাম জেলার এরকম বহু ঘটনার সাক্ষী থাকার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here