বিবর্তনের হাত ধরে যেভাবে শুরু হয়েছিল বাংলার দুর্গাপুজো

Advertisement
উনবিংশ শতকের শেষের থেকে বিংশ শতকের প্রথম লগ্নে আবারও চরিত্র বদল ঘটে বাংলার শারদীয়া উৎসব বা দুর্গাপুজোর। যা ছিল এতদিন শ্বেতাঙ্গদের মনোরঞ্জনের উৎসব, হঠাৎই তা‌ হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের ভারত থেকে উৎখাত করার অন্যতম হাতিয়ার। উনবিংশ শতকের শেষ থেকেই বাড়ির মেয়ের আদলে দুর্গাপুজোর পরিবর্তে, দেবী দুর্গাকে দেশমাতা হিসাবেই খুঁজে পেতে চান ভারতীয় বিপ্লবীরা। স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে দেবী দুর্গা হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এগিয়ে চলার শক্তি।
বিবর্তনের হাত ধরে যেভাবে শুরু হয়েছিল বাংলার দুর্গাপুজো

প্রতিভা গাঙ্গুলী : দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়েছিল বহু প্রাচীনকাল থেকেই। পুজো শুরুর যথার্থ কোনও নথি পাওয়া না গেলেও জানা যায়, বৈদিক সাহিত্যে দেবী দুর্গার পরিচয় রয়েছে। অনেকের মতে, সম্ভবত মোগল আমলে ধনী পরিবারগুলিতে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন ঘটে। তবে ইতিহাস বলছে, আনুমানিক পনেরশো শতকের শেষের দিকে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল।

জানা গিয়েছে, দিনাজপুর-মালদার জমিদার স্বপ্নাদেশে প্রথম পারিবারিক দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। তবে সে সময় দুর্গার রূপ ছিল অন্যরকম। লোককথা অনুযায়ী, আদি দুর্গার চোখ ছিল গোলাকার ও উজ্জ্বল এবং সাদা বাঘ ও সিংহের উপর বিরাজ করতেন তিনি। অন্য তথ্য অনুসারে, তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বা নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় প্রথম শারদীয়া বা‌ শরৎকালীন দুর্গাপুজোর শুরু করেন। অন্যদিকে কলকাতায় ১৬১০ সালে বড়িশার রায়চৌধুরী পরিবার প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন।

তবে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর রাজা নবকৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভকে খুশি করার জন্য কলকাতা শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। পরে অবশ্য ব্রিটিশ বাংলায় এই পুজো ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই দুর্গাপুজো পরবর্তীকালে স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়ে ওঠে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯২০ সালে কলকাতায় প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বারোয়ারি পুজো শুরু হয়। এরপর থেকে এই পুজো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলায়।

পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে বাংলার নবাবদের পরাজয়ের ফলে শুধুমাত্র বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সমাজ জীবনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এসময় নবাবরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য এবং সেই সময়কার বেশকিছু জমিদার, শাসকদের কাছে সুনজরে থাকার জন্য এবং ব্রিটিশ তোষামোদের জন্য জাঁকজমকভাবে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিল। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে যেমন প্রজাদের প্রতি তাদের শাসনকে কায়েম রাখা, তেমনি মালিক ইংরেজদের সুনজরে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এর ফলে সেই সময় বেশকিছু জমিদার বাড়িতে জাঁকজমকভাবে কয়েকদিন ধরেই চলতো দুর্গাপুজো।

এদিকে সদ্য গজিয়ে ওঠা শহরতলি‌ কোলকাতার ব্যবসায়ীরা নিজেদের জায়গাকে পাকাপাকি করতে, কলকাতার বুকে নতুন করে পুজোর আয়োজন করেন। তাঁদেরও উদ্দেশ্য ছিল একদিকে ব্রিটিশ শাসকদের কাছে নিজেদেরকে‌ সম্মান বাড়ানো, সুনজরে থাকা, তেমনি আবার আর্থিক দিক থেকে উন্নতি করে তোলা। শোনা যায় সেসময় বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের বাড়িতে জাঁকজমকভাবে যে পুজো হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তার দায়ভার গ্রহণ করত ইংরেজ কোম্পানি। শারদীয়া উৎসবের আয়োজনে চলত গান, নাচ, খাওয়া-দাওয়া সব মিলিয়ে সে এক এলাহি ব্যাপার।

উনবিংশ শতকের শেষের থেকে বিংশ শতকের প্রথম লগ্নে আবারও চরিত্র বদল ঘটে বাংলার শারদীয়া উৎসব বা দুর্গাপুজোর। যা ছিল এতদিন শ্বেতাঙ্গদের মনোরঞ্জনের উৎসব, হঠাৎই তা‌ হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের ভারত থেকে উৎখাত করার অন্যতম হাতিয়ার। উনবিংশ শতকের শেষ থেকেই বাড়ির মেয়ের আদলে দুর্গাপুজোর পরিবর্তে, দেবী দুর্গাকে দেশমাতা হিসাবেই খুঁজে পেতে চান ভারতীয় বিপ্লবীরা। স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে দেবী দুর্গা হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এগিয়ে চলার শক্তি। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি সেক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রটিও ভারতীয় সৈনিকদের দেশ বন্দনার কাজে করেছিল উদ্বুদ্ধ। তাই সেই সময় বাংলার দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন চোখে পড়ে।

দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয় দেশমাতৃকা রূপে। তখন থেকেই শুরু হয় সর্বজনীন পুজো। সমকালীন ইতিহাস থেকে জানা গিয়েছে, সেসময় উত্তর কলকাতার মানিকতলাতেই প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপুজোর প্রচলন ঘটে। যা‌ ‘কংগ্রেস পুজো’ নামে পরিচিত ছিল। সে সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে দুর্গার ছবির নীচে লেখা হত দেশাত্মবোধক গান, বিভিন্ন স্লোগান।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মধ্যে দিয়ে বাংলার দুর্গাপুজোয় আবারও পরিবর্তন সূচিত হয়। সেসময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, ব্যানারে, বিভিন্ন দেওয়ালে লেখা হতে থাকে ‘নাথিং বিদেশি এভরিথিং স্বদেশী’। যা ভারতীয় স্বদেশী আন্দোলনকে জোরালো করে তুলতে ব্যাপক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কোথাও কোথাও আবার দেবী দুর্গার গায়ে পড়ানো হয় খাদির পোশাক।

ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশদের যোগ্য জবাব দেওয়ার অভিপ্রায়ে সেই সময় বন্দি আবস্থাতেও দুর্গাপুজোর প্রচলন ঘটান। কারাগারের মধ্যেই করা হয় দেশমাতৃকা রূপে দেবী দুর্গার আরাধনা। ১৯২৫ সালে বন্ধুকে লেখা নেতাজির একটি চিঠি থেকে এই তথ্য জানা গিয়েছে।

দুর্গাপুজোয় সেই সময় ব্যাপকভাবে লাঠি খেলার প্রচলন ছিল। আসলে এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুশীলনের একটি বিশেষ পথ। ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে নিজেদের লাঠিযোদ্ধা করে তুলতেই ভারতীয় বিপ্লবীরা এই অনুশীলনের পথে পা রেখেছিলেন। এখনও বাগবাজারে প্রতিবছর দুর্গাপুজোয় এই লাঠি খেলার প্রচলন আছে। সেসময় বিভিন্ন ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদিকে ব্রিটিশদের অত্যাচার-দুর্ভিক্ষ-খরা-বন্যা-ভূমিকম্প-অর্থনৈতিক দুর্দশা ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবী দুর্গাকে আরাধনা করা হত দুর্গতিনাশিনী রূপে। তৎকালীন বাংলা পত্রিকাতেও এই ভাব ফুটে উঠেছে।

এভাবেই সময়ের হাত ধরে চলতে চলতে, বাঁক বদলের পথে হাঁটতে হাঁটতে অতীতকাল থেকে বর্তমান সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে আজকের দুর্গাপুজো। অতীতের পুজোর আর বর্তমানের পুজোর বিস্তর ফারাক ঘটলেও মাতৃশক্তির আরাধনা-ই এই পুজোর মূল উদ্দেশ্য। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, সেই সময় বিভিন্ন জমিদার বাড়িতে বা কলকাতার বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের ঘরে ঝাড়লন্ঠন, মূর্তি, প্রতিমার সাজ, ঝালর, গয়না ইত্যাদি বিষয়ে যে প্রতিযোগিতা ছিল, তা আজও একইরকম রয়ে গিয়েছে কার্নিভালের যুগেও। শুধু পরিবর্তন ঘটেছে পরিস্থিতি আর চিন্তাধারার। সেদিনেও যেমন টক্কর দেবার মানসিকতা ছিল, আজও যেন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আয়োজকদের মধ্যে রয়েছে একে অপরকে ছাপিয়ে নতুনত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে মাতৃশক্তির আরাধনা করা।

Advertisement
Previous articleমাত্র ৯ বছরেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে ১৪ শতাংশ প্রবালপ্রাচীর
Next articleব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো : এখানে সন্ধিপুজোয় বাড়ির মেয়েরা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here