আজ কোথায় ‘ভাদু’! এক সময় আমোদপুরেই বসত ভাদু প্রতিযোগিতার আসর

Advertisement
স্থানীয় টাউন ক্লাব আমোদপুরের ভাদু দল ও জেলার অন্যান্য ভাদু দলকে টিকিয়ে রাখতে এক সময়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছিল। তৎকালীন টাউন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক দাস ১৯৯৪ সাল নাগাদ ক্লাব সংলগ্ন স্থানে আয়োজন করেছিলেন ভাদু গানের প্রতিযোগিতার আসর। সেবার জেলা এবং জেলার বাইরে থেকে প্রায় ১৫টি ভাদু গানের দল নিয়ে শুরু হয়েছিল এই ভাদু গানের প্রতিযোগিতা।
আজ কোথায় ‘ভাদু’! এক সময় আমোদপুরেই বসত ভাদু প্রতিযোগিতার আসর
Vadhu Idol – Image by Soumyadipta Bose

সুজয় ঘোষাল ও বিশ্বজিৎ ঘোষ : রাঢ় বাংলার কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য জীবনের অন্যতম ঋতুভিত্তিক ব্রতসঙ্গীত হল ‘ভাদু গান’। যা বাংলার ভাদ্র মাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। এক সময়ে বীরভূম জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ছিল ভাদু নাচের দল। তাঁরা গ্রাম পরিক্রমাকালে শোনাতেন ভাদু গানের মহত্ত্ব। ভাদু গানের তালের সঙ্গে নৃত্য কৌশলও সেসময়ে বিনোদনের অন্যতম উপকরণ ছিল। তবে সেই ‘ভাদু গান’ আজ যেন অনেকটাই বিবর্ণ গোটা রাঢ়বঙ্গে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে এই গানের চিরাচরিত ঐতিহ্যও।

বীরভূম জেলার আমোদপুরে এক সময়ে এই ভাদু গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এই অঞ্চলের দাসপাড়াতে বেশ কয়েকজনের মিলিত একটি দলও ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দলটি স্থানীয় স্তরে অনেকটাই নামডাক করেছিল। তবে বর্তমানে সেই দলের আর কোনও অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। তাই ভাদ্র মাসের প্রথম দিকে এঁদের বাড়িতে যেমন আর ভাদু পাতার তোড়জোড় থাকে না, তেমনি ভাদ্র মাসের সমাপ্তিতে ভাদু বিসর্জনের বিষাদের বাজনাও আর শোনা যায় না। ‘ভাদু গান’ যেন এখানে আজ পুরোটাই অতীত।

আমোদপুরের দাসপাড়ার এই ভাদু গানের দলটি তৈরি করেছিলেন শিবু দাস। তিনি তখন এই পাড়ারই বেশ কয়েকজন যুবককে ভাদু গানের তালিম দিতেন। একটি দলে ৭-৮ জন সদস্য থাকত। তাঁদের কেউ ছিলেন গায়েন, কেউ ছিলেন বাজনাদার, আবার কেউ ছিলেন নৃত্যশিল্পী। ভাদ্র মাসের শুরু থেকেই এই দলটি আমোদপুরের বিভিন্ন পাড়ায় ও পাশ্ববর্তী গ্রামগুলিতে ভাদু মূর্তি নিয়ে বেরিয়ে পরত।

শিবু দাসের পরবর্তী প্রজন্ম ধীরেন দাস এই ভাদু গানের ঐতিহ্যকে কোনওরকমে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ধীরেন দাস শুধুমাত্র জনপ্রিয় ভাদু গানের শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লোটো গানেরও শিল্পী। তাঁর সময়ে ভাদু গানের এই দলটি বিভিন্ন জায়গায় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার জিতে এনেছিল। তাঁর দলে মাধাই দাস ছিলেন ঢোলবাদক ও ক্ষুদিরাম দাস ছিলেন নাচুনে। তিনি মেয়ে সেজে মেয়েলী ঢঙে নৃত্য পরিবেশন করতেন।

ধীরেন দাসের এই ভাদু দলের সদস্য হিসাবে একমাত্র মাধাই দাস-ই এখনও জীবিত রয়েছেন। তিনি জানালেন, দাসপাড়ার এই মাধাই দাস, ধীরেন দাস এঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন কোনও না কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত। দিন শেষে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় ভাদুর গানের রেওয়াজ চলত তাঁদের। ভাদ্র মাসের শুরুতে ভাদু মূর্তি গড়ে পুজো হত। তারপর ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদুর বিসর্জন হত।


আজ কোথায় ‘ভাদু’! এক সময় আমোদপুরেই বসত ভাদু প্রতিযোগিতার আসর 2`
Vadhu competition – Ahmadpur, Birbhum

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, স্থানীয় টাউন ক্লাব আমোদপুরের ভাদু দল ও জেলার অন্যান্য ভাদু দলকে টিকিয়ে রাখতে এক সময়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছিল। তৎকালীন টাউন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক দাস ১৯৯৪ সাল নাগাদ ক্লাব সংলগ্ন স্থানে আয়োজন করেছিলেন ভাদু গানের প্রতিযোগিতার আসর। সেবার জেলা এবং জেলার বাইরে থেকে প্রায় ১৫টি ভাদু গানের দল নিয়ে শুরু হয়েছিল এই ভাদু গানের প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা চলেছিল দুপুর ১২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। সেবছর প্রতিযোগিতার শেষে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দলকে পুরস্কৃত করার পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ বাদক, নৃত্যশিল্পী ও গায়েনকেও সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল। টানা ৭ বছর এই রীতিতে চলেছিল প্রতিযোগিতা। পরে বেশ কয়েকবছর এই প্রতিযোগিতা বন্ধ থাকে।

টাউন ক্লাবের ভাদু গানের এই প্রতিযোগিতা এতটাই জনপ্রিয় ছিল, এক বছর এই প্রতিযোগিতা দেখতে বিখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী স্বপ্না চক্রবর্তী ও বাউল সম্রাট কার্তিক দাস বাউল উপস্থিত হয়েছিলেন। আর একটি বিশেষত্ব এখানে উল্লেখ করতে হয়, এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে শান্তিনিকেতনের পারুলডাঙা থেকে আসত মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত একটি ভাদু দল।

পরে এই প্রতিযোগিতার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। ক্লাবের সদস্যরা অনেক প্রচেষ্টার পরেও প্রতিযোগিতার আসর টিকিয়ে রাখতে পারেননি। তার অন্যতম কারণ, ভাদু দলের অভাব। বিভিন্ন কারণে ততদিনে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে শুরু করেছিল ভাদু গানের দল।

২০১৪-১৫ সালে শেষ বারের জন্য টাউন ক্লাব সংলগ্ন হাটতলায় ভাদু প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। তারপর আমোদপুরের বুক থেকে হারিয়ে গেল এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিযোগিতা। দাসপাড়া ভাদুগানের শিল্পী মাধাই দাস আবেগ ভরা কণ্ঠে জানালেন, “আগে ভাদ্র মাস এলেই ব্যস্ততা লাগত। ভাদু গানের প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে অধীর আগ্রহ জন্মাত। আজ সেই আগ্রহে ভাঁটা পড়েছে। তাই ভাদু গান লুপ্ত।” এই একই মন্তব্য করলেন টাউন ক্লাবের প্রাক্তন সম্পাদক কার্তিক দাস-ও।

ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ভাদু গান ও তার ঐতিহ্য। আধুনিক বিনোদন মাধ্যমের দাপটে ভাদুর মতো অন্যসব ব্যতিক্রমী লোকসংগীতগুলিও আজ বিপন্ন। তবে আমোদপুর ভাদুগানের এই সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্তে জড়িয়ে আছে দাস পাড়ার অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের ভাদু গানের সুর এবং জয়দুর্গা টাউন ক্লাবের মহতী প্রচেষ্টা।

Advertisement
Previous articleবরাবরই অসহায় মুমূর্ষু রোগীদের নিশ্চিত ভরসা ‘রক্তযোদ্ধা’ লাল্টু মিদ্যা
Next articleশুরু হতে যাচ্ছে গবাদি পশুদের ব্রুসেল্লোসিস রোগের টিকাকরণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here