যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজ সৈন্যদের খাবার জোগানোর জন্য ব্রিটিশদের গোরা সৈন্যরা সেবার গোপনে বোলপুর রেলষ্টেশনে চাল পাচার করছিল। একদিকে দেশের মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। তাই ১৯৪২ সালের ২৯ আগস্ট বোলপুরের স্থানীয় বিপ্লবীদের একটি দল বোলপুর স্টেশনে জড় হয়, ব্রিটিশদের চাল পাচারের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করার জন্য। পাশ্ববর্তী মোষঢাল আদিবাসী গ্রাম থেকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষ সেদিন তাদের কুড়াল, টাঙ্গি, বর্শা, তির-ধনুক নিয়ে গোরা সৈন্যদের আটকাতে ছুটে এসেছিল। |

সুজয় ঘোষাল : তখন দেশজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব অব্যাহত। ক্রিপস-দৌতের প্রয়াস ব্যর্থতার পর ভারতবাসীর কাছে একথা স্পষ্ট যে, যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার ভারতের সাংবিধানিক সংস্কার আনতে আগ্রহী নয়। এতদিন পর্যন্ত নেহেরু থেকে গাঁধী প্রমুখ জাতীয় নেতৃত্ব নিশ্চিত হন, গণ আনন্দোলনের পথে না হেঁটে ব্রিটিশদের কাছ থেকে সম্মানজনক মীমাংসা করার প্রচেষ্টা বৃথা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফসলের অজম্মার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়। এরই মধ্যে সুভাষচন্দ্র বসু ছদ্মবেশে ভারত ত্যাগ (১৯৪১), ব্রিটিশ সরকারকে ভারত থেকে সমূলে উৎপাটিত যথাসম্ভব প্রয়াস, দেশবাসীর কাছে আবেগ ও উম্মদনা সৃষ্টি করে। তার উপর ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা ঘনিয়ে এলে গাঁধীজি হরিজন পত্রিকায় দাবী করেন, ব্রিটিশদের ভারতছাড়া করলে, তবেই জাপানি আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব।
১৯৪২ সালে ওয়ার্ধায় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ভারত ছাড়ো প্রস্তাব সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার এই প্রস্তাবকে আলোচনার অযোগ্য মনে করেন। এই সময় গাঁধীজি ভারতবাসীকে আহ্বান দিলেন, “We shall do or die. We shall either free India or die in the attempt” মন্ত্রে। ৮ আগস্ট মধ্য রাতে গাঁধী, মৌলানা আজাদ সহ শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারিতে, ৯ আগস্ট সমগ্র ভারতবর্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারতছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়।
বাংলায় মেদিনীপুর ও তমলুক মহকুমায় ভারতছাড়ো আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। এর পাশাপাশি বীরভূমেও ভারতছাড়ো আন্দোলন প্রত্যক্ষ ছাপ রেখেছিল। যদিও বীরভূম জেলার নাম জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে খুব একটা আসেনি। বীরভূমে ভারতছাড়ো আন্দোলনের সূচনা ১৯৪২ সালের ১৩ আগস্ট। বীরভূমে জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক লালবিহারী সিংহের ডাকে জনগণ একত্রিত হতে থাকে। বীরভূমে সেবার খাদ্যসংকটে জেরবার সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। বীরভূমের বোলপুর রেলষ্টেশন সেসময় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজ সৈন্যদের খাবার জোগানোর জন্য ব্রিটিশদের গোরা সৈন্যরা সেবার গোপনে বোলপুর রেলষ্টেশনে চাল পাচার করছিল। একদিকে দেশের মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। তাই ১৯৪২ সালের ২৯ আগস্ট বোলপুরের স্থানীয় বিপ্লবীদের একটি দল বোলপুর স্টেশনে জড় হয়, ব্রিটিশদের চাল পাচারের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করার জন্য। পাশ্ববর্তী মোষঢাল আদিবাসী গ্রাম থেকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষ সেদিন তাদের কুড়াল, টাঙ্গি, বর্শা, তির-ধনুক নিয়ে গোরা সৈন্যদের আটকাতে ছুটে এসেছিল। পুলিশ ও জনতার সেই খণ্ডযুদ্ধে সেদিন ১৩ জন আহতের পাশাপাশি মোষঢালের আদিবাসী নেতা জটা মুর্মু নিহত হন, অন্যদিকে বোলপুরের কালিকাপুরের ২২ বছরের যুবক তাঁরাপদ গুই গোরা সৈন্যদের গুলিতে শহিদ হন। গোরা সৈন্যদের মধ্যে একজন নিহত ও ৯ জন আহত হয়েছিল।
পরের দিন রেলসম্পত্তি নষ্টের জন্য পুলিশ বেশকিছু বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনার স্মৃতি রক্ষার্থে বোলপুর রেলষ্টেশনের বাইরে তাঁরাপদ গুই ও জটা মুর্মু আত্মবলিদানের শ্রদ্ধাঞ্জলী স্বরূপ একটি শহিদ স্মারক স্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। স্মারকটির নীচে লেখা রয়েছে, “১৯৪২ এর ২৯শে আগস্ট বোলপুর রেলষ্টেশনে ব্রিটিশ শাসকের গুলিতে যাঁরা নিহত হয়েছেন- তাঁদের স্মরণে।”