১লা বৈশাখ : যে কারণে একই নববর্ষ দুই দেশে দুই দিনে পালিত হয়

Advertisement
দেশ ভাগের আগে পর্যন্ত এই পঞ্জিকার আরও কয়েকবার সংস্করণ ঘটে। যার মধ্যে বিশেষভাবে সংস্করণ ঘটানো হয় ১৮৬৯ ও ১৮৯০ সালে। তবে এই পঞ্জিকা তখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান সম্মত ছিল না। প্রথম বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ১৯৫২ সালে বাংলা পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। তবে এই পঞ্জিকায় হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রকেও অনেকাংশে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কারণ বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের সুবিধা ছিল এখানে।
কারণে একই নববর্ষ দুই দেশে দুই দিনে পালিত হয়

সজয় পাল : সময়ের চাকায় ভর করে চলে এলো আরও একটি নতুন বাংলা বছর। সেই সঙ্গে পরিবর্তন ঘটল বাংলা ক্যালেন্ডারের। যদিও পশ্চিমবঙ্গের একদিন আগেই বাংলাদেশ পালন করে ফেলেছে এই নববর্ষ। কারণ ১৪ এপ্রিল সেদেশে প্রবেশ করে ফেলেছে ‘১লা বৈশাখ’। একদিন পিছিয়ে ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ পালন করছে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা। আর এখানেই দ্বিবিভক্ত দুই দেশের বাঙালি সম্প্রদায়।

যদিও বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির গোড়াতে এরকম কোনও বিভাজন ছিল না। একই ক্যালেন্ডার দেশ ভাগ হওয়ার পরেও ব্যবহার করেছে ভারত ও বাংলাদেশের বাঙালিরা। সেসময়ে ‘১লা বৈশাখ’ একই দিনে পেয়েছে দুই দেশ। পরে বিভিন্ন কারণে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশের বাংলা ক্যালেন্ডার। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ক্যালেন্ডার অবশ্য ১৯৫২ সাল থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে।

এখানে পরিবর্তন বলতে বারংবার সংস্করণকে বলা হচ্ছে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন কারণে একাধিকবার সংস্কার করা হয়েছে এই বাংলা ক্যালেন্ডার। এতবার সংস্কার বোধহয় অন্য কোনও ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার কপালে জোটেনি।

ধারণা করা হয় গৌড় অধিপতি শশাঙ্কের সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের দিকে প্রথম বাংলা ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটেছিল। পরে এই বাংলা ক্যালেন্ডারের বড়ো রকম সংস্করণ ঘটে মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। এই পরিবর্তন খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য করা হয়েছিল। মুঘলরা খাজনা আদায় করত তাদের হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী। এই পঞ্জিকা চাঁদের উপর নির্ভরশীল ছিল, যা কৃষি ফলনের সঙ্গে কোনওভাবেই মিলত না। এই অসুবিধা দূর করতে সম্রাট আকবরের নির্দেশে রাজ জ্যোতিষ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন ও হিজরি সনের সংমিশ্রণে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ একটি নতুন বাংলা পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটান। সম্রাট আকবর এর নাম দেন ‘তারিখ-এ-এলাহি’।

দেশ ভাগের আগে পর্যন্ত এই পঞ্জিকার আরও কয়েকবার সংস্করণ ঘটে। যার মধ্যে বিশেষভাবে সংস্করণ ঘটানো হয় ১৮৬৯ ও ১৮৯০ সালে। তবে এই পঞ্জিকা তখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান সম্মত ছিল না। প্রথম বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ১৯৫২ সালে বাংলা পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। তবে এই পঞ্জিকায় হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রকেও অনেকাংশে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কারণ বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের সুবিধা ছিল এখানে।

মেঘনাদ সাহার এই পঞ্জিকা সেসময়ে বিভক্ত দুই বাংলায় সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু পরে বাংলাদেশ আরও কয়েকবার বাংলা পঞ্জিকার সংস্করণ করে। মূলত ১৯৬৩ সাল থেকে বিভক্ত হয়ে যায় দুই বাংলার বাংলা পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার। ওই সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ড. শহীদুল্লাহ-র সভাপতিত্বে সংস্কার করা হয় বাংলা ক্যালেন্ডারের। আর এই সময় থেকেই ওই ক্যালেন্ডারের বাংলা মাসের প্রথম ৫টি মাস ৩১ দিনে ও বাকি মাসগুলি ৩০ দিনে শেষ হতে শুরু করে।

বাংলাদেশের এই ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয়বার বড়ো সংস্করণ করা হয় ১৯৯৫ সালে। এই সময় থেকে ফাল্গুন মাসকে বেছে নেওয়া হয় লিপ ইয়ারের মাস হিসাবে। ইংরেজি লিপ ইয়ারের সঙ্গে সংযোগ রেখে প্রতি লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাস শেষ হয় ৩১ দিনে। আর ‘১লা বৈশাখ’ পালন করা হয় ১৪ এপ্রিল।

এই ক্যালেন্ডার সংস্করণ করা হয়েছিল বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিশেষ কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনকে লক্ষ্য করে। ‘১৬ই ডিসেম্বর’, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’, ‘২৬শে মার্চ’ এরকম বিশেষ কয়েকটি দিনকে বাংলা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নতুন ক্যালেন্ডার নির্বাচন করা হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে বলতে হয়, ১৯৭১ সালের ‘১৬ই ডিসেম্বর’ (যাকে বাংলাদেশীরা বিজয় দিবস আখ্যা দিয়েছে) ছিল বাংলায় ১ পৌষ। প্রতি বছর বাংলা ও ইংরেজি এই তারিখ দুটি যাতে একই দিনে পড়ে, সেদিকে নজর দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের বাংলা একাডেমী সর্বশেষ সেদেশের বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্করণ করে ২০১৯ সাল বা ১৪২৬ বঙ্গাব্দে। এই ক্যালেন্ডারে বাংলার প্রথম ৬ মাস ৩১ দিনের এবং ফাল্গুন বাদে বাকি ৫ মাস ৩০ দিনের করা হয়েছে। ফাল্গুন মাস করা হয়েছে ২৯ দিনের, তবে লিপ ইয়ারে এই মাস হয়ে যায় ৩০ দিনে। এই ক্যালেন্ডার রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী ও তাঁদের প্রয়াণ দিবসগুলিকেও বাংলা তারিখের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়েছে।

তবে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকায় ১৯৫২ সালের পর বিশেষ কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। তাই ‘১লা বৈশাখ’ এখানে ১৫ এপ্রিল পালন করা হয়। তবে কোনও কোনও বছর পশ্চিমবঙ্গেও ‘১লা বৈশাখ’ অনুষ্ঠিত হয় ১৪ এপ্রিলে। এই যেমন গত বছরই অর্থাৎ ১৪২৭ বঙ্গাব্দের ‘১লা বৈশাখ’ উভয় দেশেই পালন করা হয়েছিল একই দিনে, ১৪ এপ্রিল। কিন্তু এবছর পুনরায় ‘১লা বৈশাখ’-এর দিন পরিবর্তন ঘটেছে।

Advertisement
Previous articleআজও সমান জনপ্রিয় রামনগরের রামেশ্বর শিবের চড়ক
Next articleগ্রামীণ সত্ত্বার ক্ষুদ্র অবয়বকে কিছুক্ষণের জন্য তুলে ধরে আমোদপুরের চড়ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here