সারা বাংলায় একমাত্র লোকপুরে-ই টিকে রয়েছে ‘সেরপাই’ শিল্প (ভিডিও সহ)

Advertisement
‘সেরপাই’ শিল্পের মূল উপাদান কাঠ ও পিতল। কাঠ হিসাবে ব্যবহার করা হয় আম, সোনাঝুরি। কাঠগুলিকে জলে ভিজিয়ে কষ বের করে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শুকানোর পর পরিমাপ করে কাটা হয়। এখানে মেশিনে কাঠগুলিকে কাটা হয় গোলাকৃতিতে। কাঠের মাঝখানটা কুঁদে নেওয়া হয়। তারপর সেই কাঠে রঙও করা হয়। রঙের পর্ব মিটে যাওয়ার পর কাঠের গায়ে মাপ মতো পিতলের পাত বসানো হয় সমান্তরালভাবে। সেই পাতে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন রকমের নকশা। সবশেষে পালিশ করে ‘সেরপাই’-এর উজ্জ্বলতা ফুটিয়ে তোলা হয়। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি
সারা বাংলায় একমাত্র লোকপুরে-ই টিকে রয়েছে লুপ্তপ্রায় ‘সেরপাই’ শিল্প

সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল : ‘সেরপাই’ এর ব্যবহার উঠে গিয়েছে বহুদিন আগেই। এখন ওজন মাপতে মেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তবে এককালে গ্রাম-বাংলার প্রতিটি প্রান্তে ওজন মাপতে ব্যবহার করা হত এই ‘সেরপাই’। তখন চাল, ডাল, ধান প্রভৃতি যা কিছু মাপার, একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাপনী হিসাবে নির্ভর করতে হত এই ‘সেরপাই’-এর উপরেই।

‘সেরপাই’ একটি পুরনো বাংলা শব্দ। এখানে ‘সের’ ও ‘পাই’ উভয়ই একটি করে পরিমাপের একক। তবে ‘পাই’ এসেছে সম্ভবত পরিমাপের একক ‘পোয়া’ থেকে। পরে ‘সের’ ও ‘পাই’ শব্দ দুটি মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছে এই ‘সেরপাই’। যা একটি পরিমাপের পাত্র বিশেষ। সেকালে এই পাত্রটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেত দিয়ে তৈরি হত। তবে ধাতু বা কাষ্ঠের ‘সেরপাই’-এর চলও সেসময়ে ছিল।

এখন সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ফুরিয়েছে ‘সেইপাই’-এরও। আধুনিক প্রজন্ম সেকালের ‘সেরপাই’ ফেলে ওজন মাপতে বেছে নিয়েছে ‘দাঁড়িপাল্লা’। ‘দাঁড়িপাল্লা’-তেও যুগে যুগে এসেছে একাধিক পরিবর্তন।

সে যাইহোক, এককালের সস্তার সেই ‘সেরপাই’ আজ আভিজাত্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সাদামাটা সেকালের ‘সেরপাই’ আজ সেজে উঠেছে শিল্পীর নিখুঁত পরিকল্পনা ও অসীম ধৈর্যের অলঙ্করণে। বলা বাহুল্য, সমগ্র বঙ্গদেশে এখন একটি স্থানেই তৈরি হয় এই ‘সেরপাই’। সেটি বীরভূম জেলার খয়রাশোল ব্লকের লোকপুর।

লোকপুর ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী একটি প্রান্তিক গ্রাম। বীরভূমের সদর শহর সিউড়ি থেকে গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। ছোটোনাগপুর মালভূমির অংশবিশেষ হওয়ায় এখানকার মাটি কাকুরে ও প্রায় রুক্ষ প্রকৃতির। তা সত্ত্বেও লোকশিল্প অনুরাগীদের কাছে এই গ্রামটি বরাবরই ‘সেরপাই’ শিল্পের পীঠস্থান নামে পরিচিত হয়ে রয়েছে। আর এই ‘সেরপাই’ শিল্পের জন্যই এই গ্রামটির পরিচিতি এখন জেলা ছাপিয়ে রাজ্য, রাজ্য ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছে দেশ ও বিদেশে।

লোকপুরে এখন একমাত্র শিল্পী হিসাবে চাহিদা অনুযায়ী ‘সেরপাই’ তৈরি করেন এই গ্রামেরই বাসিন্দা ভোলানাথ কর্মকার ও তার পরিবার। আর এটিই তাঁর পারিবারিক শিল্পকর্ম। ১৯১৩ সালে বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটে বীরভূম জেলার গ্রন্থাকার O Malley একটি প্রবন্ধে লোকপুরের ‘সেরপাই’ শিল্প ও তার শিল্পী রাখাল কর্মকারের কথা উল্লেখ করেছিলেন। যদিও ভোলানাথ কর্মকার জনদর্পণ প্রতিনিধিকে জানালেন, রাখাল কর্মকারের চারপুরুষ আগেও ‘সেরপাই’ তৈরি করত তাঁদের পরিবার। নবীন কর্মকার ইংরেজী ১৭৮৫ সালে ‘সেরপাই’-এর গায়ে পিতলের অলংকরণ বসানোর পদ্ধতি প্রথম চালু করেন। তবে রাখাল কর্মকারের হাত ধরেই এই শিল্পের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ঘটেছিল। রাখাল কর্মকারের চার ছেলেও ‘সেরপাই’ শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই শিল্পের কদর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।

Sherpai Art of Birbhum – video

পরে ১৯৫৮-৫৯ সাল নাগাদ শান্তিনিকেতন নিবাসী ও তৎকালীন লোকসভার সদস্য অনিল কুমার চন্দ্র-র নজরে আসে ‘সেরপাই’ শিল্প। তিনি এই শিল্পকে টেনে তোলার সমস্ত রকম চেষ্টা চালাতে থাকেন। তাঁর চেষ্টাতেই ভারত সরকারের অধীনস্থ ‘হান্ডিক্রাফট’ বিভাগ মাঝে-মধ্যেই কর্মকার পরিবারকে অর্ডার দিত ‘সেরপাই’-এর। তারও পরে ‘সেরপাই’ শিল্পের জন্য ১৯৬৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের হাত থেকে শ্রেষ্ঠ লোকশিল্প পুরস্কার পান রাখাল কর্মকারের সুযোগ্য পুত্র কমলাকান্ত কর্মকার।

আরও এক শিল্পীর নাম এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, তিনি ছিলেন রাখাল কর্মকারের পৌত্র ফটিক কর্মকারের ছেলে কার্তিক কর্মকার। তিনি ‘সেরপাই’ শিল্পী হিসাবে কেন্দ্র, রাজ্য ও জেলা স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর ছেলে কৈলাস কর্মকারও এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

বর্তমানে এই শিল্পকে কঠোর পরিশ্রমে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে চলেছেন কৈলাস কর্মকারের জামাতা ভোলানাথ কর্মকার। তিনি কৈলাস কর্মকারের মেয়ে রুমা কর্মকারের স্বামী। ভোলানাথ বাবু ২০১৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় হাত থেকে লোকশিল্প পুরস্কারও পেয়েছেন।

কীভাবে প্রস্তুত হয় ‘সেরপাই’, এব্যাপারেও জনদর্পণ প্রতিনিধিকে কিছুটা ধারণা দিয়েছেন শিল্পী ভোলানাথ কর্মকার। তিনি জানালেন, ‘সেরপাই’ শিল্পের মূল উপাদান কাঠ ও পিতল। কাঠ হিসাবে ব্যবহার করা হয় আম, সোনাঝুরি। কাঠগুলিকে জলে ভিজিয়ে কষ বের করে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শুকানোর পর পরিমাপ করে কাটা হয়। এখানে মেশিনে কাঠগুলিকে কাটা হয় গোলাকৃতিতে। কাঠের মাঝখানটা কুঁদে নেওয়া হয়। তারপর সেই কাঠে রঙও করা হয়।

রঙের পর্ব মিটে যাওয়ার পর কাঠের গায়ে মাপ মতো পিতলের পাত বসানো হয় সমান্তরালভাবে। সেই পাতে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন রকমের নকশা। সবশেষে পালিশ করে ‘সেরপাই’-এর উজ্জ্বলতা ফুটিয়ে তোলা হয়।

ভোলানাথ বাবু আরও জানালেন, যেহেতু ‘সেরপাই’ একটি নিখুঁত সূক্ষ্ম ও পরিশ্রমের কাজ, তাই একটি ‘সেরপাই’ তৈরি করতে সময় লেগে যায় বেশ কয়েকদিন। এক একটি সেটে ৫-৬টি বিভিন্ন আকারের ‘সেরপাই’ সাজিয়ে বিক্রি করতে হয়। যার প্রতিটি সেটের মূল্য রাখা হয় গড়ে ৮০০ থেকে ৯ হাজার টাকা।

Advertisement
Previous articleকর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত ছুটি পেতে একই স্ত্রীকে ৪ বার বিয়ে করে ৩ বার ডিভোর্স
Next article৭৯ বছর পর পোস্টকার্ড ফিরে গেল প্রেরকের ঠিকানায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here