ভারতীয় কবিতার মহাবৃক্ষ শঙ্খ ঘোষ, আমাদের অস্তিত্বে একটি সজাগ প্রকাশ

Advertisement
পরিপার্শ্বের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রশ্নময় সেই মানুষটি এত সুভদ্র মানুষ! এত ভদ্র ভাব! এরকম খুব একটা দেখা যায় না। ভদ্র ভাব নিয়ে সব সময়ই কথা বলতেন। কথা বলার প্রত্যেকটি শব্দে শব্দে তাঁর ভদ্রতার প্রকাশ। যেখানে আজ অভদ্র আচরণে ভরে গেছে। কবি-লেখক অনেকের ব্যবহার আজ কীরকম লাগে…! সন্দেহের। কিন্তু তিনি যেন কত যত্ন করে মানুষকে আহ্বান করতেন। তিনি সুভদ্র কবি-প্রাবন্ধিক-শিক্ষক কবি শঙ্খ ঘোষ। সত্যের পূজারী। ঈশ্বরপ্রতীম।
কবিতার মহাবৃক্ষ শঙ্খ ঘোষ আমাদের অস্তিত্বে একটি সজাগ প্রকাশ

সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায় : ১৯৮৬-তে কবি শঙ্খ ঘোষের যমুনাবতী কবিতাটি আমাদের পাড়ার ক্লাবে দুর্গা পুজোর সময় আবৃত্তি করে চিনেছিলাম। “নিভন্ত এই চুল্লিতে মা / একটু আগুন দে / আরেকটু কাল বেঁচেই থাকে / বাঁচার আনন্দে!… যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে / যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে…।” সেই শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়া। ১৯৮৭-তে সিউড়ির শিক্ষাসঙ্ঘ বইয়ের দোকান থেকে ‘বাবরের প্রার্থনা’ বইটি কিনি। এর আগে বাবার কাছেই তাঁর নাম শুনে এসেছি। ক’বছর পরেই ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ পড়ি। এরপর তাঁর একের পর এক কবিতার বই পড়ি, পড়ে চলেছি।

ওদিকে গদ্যের বই, ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’, ‘জার্নাল’, ‘এ আমির আবরণ’, ‘কবির বর্ম’, ‘এই শহরের রাখাল’, ‘কবির অভিপ্রায়’, ‘ইশারা অবিরত’ এইসব কত কত প্রবন্ধের বই পড়ে মুগ্ধ হতে থাকি। বুঝতে পারি, এই বইগুলি থেকে তেমন কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু আস্তে আস্তে আবার পড়তে পড়তে ভাবি কী অসামান্য এসব গদ্য! রেডিওতে তাঁর কবিতা পাঠ শুনে মুগ্ধ হই। পরে টিভিতে।

১৯৯২-এ মাস্টারমশাই কবিরুল ইসলাম-এর সঙ্গে সিউড়ি থেকে কলকাতা যাই এবং ঠিক পরের দিনই সন্ধ্যাবেলায় যাই উল্টোডাঙ্গা ‘ইশ্বরচন্দ্র নিবাস’-এ কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়ি। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। প্রতিমা দেবী ছিলেন। ঘণ্টা দুয়েক কবির বাসগৃহে অপেক্ষায় থাকি। তাঁর কোনও এক মেয়ের বিয়ে সামনেই। রাত আটটা বা সাড়ে আটটায়ও শঙ্খ ঘোষ ফিরে না আসায় কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়-এর ফ্ল্যাটে নিয়ে যান কবিরুলবাবু। তারপর ফিরে যাওয়া রাতে। পরে বাবার কর্মজীবনের বাসস্থান রাম দুলাল সরকার স্ট্রিট অর্থাৎ বিধান সরণি থেকে শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে গিয়েছি এক বছর, দু বছর অন্তর।

৬-৭ জুলাই ১৯৯৬ বহরমপুরে কবিতা পাক্ষিক এর অনুষ্ঠানে শঙ্খ ঘোষের দর্শন পাই। সেখানে রাত্রি বাস করি পিডব্লিউডি-র বাংলোর একটি কক্ষে। ঠিক এর পাশের কক্ষেই রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছে কবির। তিনি শুতে যাওয়ার আগে কোনও একজনকে বললেন সকালে একটা রিকশা ডেকে দেওয়ার জন্য। আমার কানে কথাটা আসে।

যাইহোক, সকালে আমিই একটি রিকশার ব্যবস্থা করি। শঙ্খবাবু খুবই ইতস্তত বোধ করেন। তাঁর অ্যাটাচিটা আমি নিতে চাচ্ছি, কিন্তু কোনও মতেই নিতে দেবেন না। তবুও হাতে তুলে নিই, আমি কোথায় যাব, এমন কিছু কথা বলতে বলতে…। তারপর রিকশায় তাঁর সঙ্গে আমাকে উঠতে বলেন। আহা! সে কী ভদ্রতায়! বেশ কিছু কথা বলার পর ধীরে ধীরে চলা। তাঁর দু-একজন পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয় পথে। কথা বিনিময় হলে আবার রিকশা চলে। মিনিট পনেরো কুড়ি কেটে যাওয়ার পর বহরমপুর বাস স্ট্যান্ড। তিনি আমাকে সাঁইথিয়ার বাসটি দেখিয়ে চেপে যেতে বলে নিজে বহরমপুর স্টেশনের দিকে এগিয়ে যান। সেই বহরমপুরের আকাশ আজও ভেসে ওঠে।

“আর কত ছোট হবো ঈশ্বর” / “কেউ রাস্তা দেবে না”, এরকমই কতই তাঁর রচিত পঙক্তি অনবরত ইশারা দেয় আমাকেও!

১৯৯৭-৯৮, এই সময়ে একদিন উল্টোডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের ওখানে ‘ইশ্বরচন্দ্র নিবাস’ খুঁজতে খুঁজতে শঙ্খ ঘোষের বাড়ি সকাল ১০টার আগেই পৌছে যাই। নিরিবিলি তার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে সেদিন দেখি কপালের রসকলি একজন মধ্যবয়সী মহিলা হাতে ছোট্ট একটি ফুল সমেত ফুলসাজি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কার সঙ্গে দেখা করবে বাবা?” বলতেই তিনি ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং একটি চেয়ারে বসতে বললেন। বললেন, “আসছেন, তুমি বসো”।

মিনিট পনেরো কুড়ি পর এলেন ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত সেই শঙ্খ ঘোষ! দেখে অবাক! আমার  মুখে কথা নেই। আবার কথা আসছে আস্তে আস্তে। আসছে না কথা, তবুও তো একা বসে আছি। তো, প্রণাম করলাম। এটা ওটা কথা চলল, আমোদপুর সম্পর্কে, তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু অধ্যাপক, লেখক জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পর্কে, কবিরুল ইসলাম সম্পর্কে।

ধীরে ধীরে ১০-১১টার সময় আরও কত লেখক, কবিমানুষ তাঁর বাড়িতে পৌঁছলেন। তাঁর গৃহে আমি খুব উপাদেয় খাবার খেয়ে ১টার সময় বেরিয়ে এসেছিলাম। আসার সময় বলেছিলেন, মঙ্গল-বুধবার নয়, তুমি এলে কোনও রবিবার দেখে বেলা দশটার পর আসতে পারো।

আজকেও টলটল করছে জলের মতো স্বচ্ছ সবই। তাঁর সেই রবিবারের আড্ডায় গিয়েছি দু-চারবার। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কি সুন্দর সুন্দর সব টিফিন পেয়েছি! যখনই গিয়েছি তার রবিবারের আড্ডায়।

একবার, প্রান্তিক স্টেশনে নেমে হেঁটে রতন কুঠির পাশ দিয়ে যাচ্ছি শান্তিনিকেতন মেলা। দেখি, হঠাৎ শঙ্খ ঘোষ এবং স্ত্রী প্রতিমা দেবী! দেখে তো অবাক! প্রণাম করলাম। কথা বললাম। এবং তাঁদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বেলা ১২টার সেই ফাঁকা-ফাঁকা শীত-রৌদ্রে পৌষমেলা তাঁর সঙ্গে দেখেছিলাম মিনিট পনেরো কুড়ি। ৭ এবং ৮ই পৌষ অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি  কিছু খবরা-খবর নিচ্ছিলেন, মনে পড়ছে। আমার ঝোলায় তখন রাখা-ই ছিল তাঁর কবিতার বই। দেখে, তিনি খুব সুন্দর হাসলেন। তখনই বললেন, “চলো আমাদের সঙ্গেই মেলাতে।”

কবির আদি নিবাস বরিশালের বানারীপাড়ায়। নাম ছিলো চিত্তপ্রিয় ঘোষ। যাইহোক, দেশভাগের লাঞ্ছনা এবং ও দেশ বাস্তুভূমি ছেড়ে আসার ক্ষত নিয়েই তিনি থেকেছেন। “এ তো সত্যি যে মুহুর্মুহু আমি বেঁচে থাকি বাংলাদেশের মধ্যেই।” বাঁচতেন এদেশে, এ রাজ্যে, কেবলই নিজেকে উদ্বাস্তু, বহিরাগত হিসেবে সেই ক্ষত তাঁকে খুব তাড়া করত।

পরিপার্শ্বের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রশ্নময় সেই মানুষটি এত সুভদ্র মানুষ! এত ভদ্র ভাব! এরকম খুব একটা দেখা যায় না। ভদ্র ভাব নিয়ে সব সময়ই কথা বলতেন। কথা বলার প্রত্যেকটি শব্দে শব্দে তাঁর ভদ্রতার প্রকাশ। যেখানে আজ অভদ্র আচরণে ভরে গেছে। কবি-লেখক অনেকের ব্যবহার আজ কীরকম লাগে…! সন্দেহের। কিন্তু তিনি যেন কত যত্ন করে মানুষকে আহ্বান করতেন। তিনি সুভদ্র কবি-প্রাবন্ধিক-শিক্ষক কবি শঙ্খ ঘোষ। সত্যের পূজারী। ঈশ্বরপ্রতীম। অপূর্ব মানুষ। এমন মানুষকে দেখা আমার সৌভাগ্য হয়েছে, এটা ভাবতেই ভালো লাগে। কথা বলছেন যেন স্নিগ্ধ নদীর মতো ছলছল স্বরে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে এবং শঙ্খ ঘোষ বিষয়ে অনেক কিছুই পড়েছি কবি জয় গোস্বামীর কত রকম লেখায়।

আজ ভারতীয় কবিতার কবি শঙ্খ ঘোষ, মানে সেই মানুষটি কোথায়! আকাশের ওপারে আকাশের দূর-দিগন্তের তারায় তাঁর প্রতি আরও কত শত-হাজার কবিতায় প্রণাম।

(লেখক : বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক)

Advertisement
Previous articleমঙ্গল অভিযান : লাল গ্রহে এবার বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন তৈরি করল নাসা
Next articleম্যালেরিয়া টিকার কার্যকারিতায় আর এক ধাপ এগোল অক্সফোর্ড

1 COMMENT

  1. ভাল লাগা জানাই। কবি-মহীরুহকে প্রণাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here