সমাজের সাফাইকর্মী সোনা দেবী নিজেই আজও অচ্ছুৎ

Advertisement
সোনা দেবীর জীবন অবশ্য আর পাঁচটা মহিলার মতো নয়। তাঁর বাবা পূর্নবাসী বাসফোড় ও মা লক্ষ্মী বাসফোড় অবিভক্ত বিহার থেকে এই অঞ্চলে আসেন। তাঁরা এসেছিলেন মূলত রেল লাইনের নালা-নর্দমা পরিষ্কার করার কর্মসূত্রে। খুব কম বয়সে সোনা দেবীর বিয়ে হয় বাবলু বাসফোড়ের সঙ্গে। বাবলু বাসফোড় কর্মসূত্রে তখন আমোদপুর ন্যাশনাল সুগারমিলের সাফাইকর্মী ছিলেন। পরে সুগার মিল বন্ধ হয়ে গেলে তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি

সমাজের সাফাইকর্মী সোনা দেবী নিজেই আজও অচ্ছুৎ
সমাজের সাফাইকর্মী সোনা দেবী নিজেই আজও অচ্ছুৎ 2

সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল : ওঁরা থাকেন শহরের একপ্রান্তে, সাধারণ মানুষের অলক্ষ্যে। শহরের নালা-নর্দমা, জমা নোংরা জল, মানুষের মলমূত্র পরিষ্কার করেই তাঁদের সংসার চলে। আর এটাই তাঁদের একমাত্র জীবনধারণের উপায়। সোজা বাংলায় সমাজে এঁরাই ‘মেথর’ নামে পরিচিত। শব্দের বিভেদে তাঁরাই আবার ‘সাফাই কর্মচারী’। এ রাজ্যে ২০১৫ সাল থেকে এঁদেরকে ‘মেথর’ লেখার পরিবর্তে ‘পরিবেশ বন্ধু’ লেখার নিয়ম চালু হয়েছে। অন্যদিকে ‘মেথর’ একটি জাতিকেও চিহ্নিত করে। সাধারণত ভাঙ্গি, ধাঙড়, ভুইমালি, বাসফোড় প্রভৃতি পদবীধারীদেরই একযোগে ‘মেথর’ বলা হয়ে থাকে।

তবে পদবী যাইহোক, তাঁদের কাজের ভূমিকা অবশ্য একই। তাঁরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে ‘Manual Scavenging’ হিসাবে। সোনা বাসফোড় এরকমই একজন ‘Manual Scvanger’, বয়স ৫৫-এর কাছাকাছি। বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া ব্লকের আমোদপুরে তাঁর বাড়ি। আমোদপুর সুগার মিল অঞ্চলের পরিত্যক্ত এক কোণে ছোট একটি কুঁড়েঘরে তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে কোনওরকমে দিনযাপন করেন।

সোনা দেবীর জীবন অবশ্য আর পাঁচটা মহিলার মতো নয়। তাঁর বাবা পূর্নবাসী বাসফোড় ও মা লক্ষ্মী বাসফোড় অবিভক্ত বিহার থেকে এই অঞ্চলে আসেন। তাঁরা এসেছিলেন মূলত রেল লাইনের নালা-নর্দমা পরিষ্কার করার কর্মসূত্রে। খুব কম বয়সে সোনা দেবীর বিয়ে হয় বাবলু বাসফোড়ের সঙ্গে। বাবলু বাসফোড় কর্মসূত্রে তখন আমোদপুর ন্যাশনাল সুগারমিলের সাফাইকর্মী ছিলেন। পরে সুগার মিল বন্ধ হয়ে গেলে তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। সুগার মিল বন্ধ হওয়ার সময়ে তিনি অবশ্য কিছু অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন। তবে সেই অর্থে খুব বেশিদিন সংসার চলেনি। তাই আবার তাঁর পুরানো পেশায় ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে।

এর অল্প কিছুদিন পরেই বাবলু বাবু রোগগ্রস্ত হয়ে মারা যান। সংসারের হাল ধরেন স্ত্রী সোনা বাসফোড়। বংশপরম্পরার পেশাকে আঁকড়ে ধরে আজও নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তেন হয় সোনা দেবীকে। নিজের হাতে অন্যের মল-মূত্র পরিষ্কার করে সামান্য যা কিছু পান, তা দিয়েই কোনওরকমে সংসার চালাতে হয় তাঁকে।

এর পরে রয়েছে আবার ছুঁতমার্গ। হ্যাঁ, আধুনিক সমাজ আজও ছুঁতমার্গ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। প্রতি নিয়ত সোনা দেবীরা সমাজের ছুঁতমার্গের শিকার হয়ে চলেছেন। সমাজ তাঁদের আজও অচ্ছুৎ করে রেখেছে। এমনকি রাস্তার সরকারি টাইমকলের জল নেওয়ার সময়েও গোটা পরিবারকে সইতে হয় লাঞ্ছনা। যারা সমাজের প্রকৃত ‘পরিবেশ বন্ধু’, সমাজে তাঁরাই আজও অবহেলিত।

ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে এতজন মানুষ নিয়ে দিনযাপন সোনা দেবীর। আমোদপুর অঞ্চলের বিচিত্র সব মানুষের ভিড়ে তিনি অবশ্যই ব্যতিক্রমী। এতটাই ব্যতিক্রমী, শহরের সুধীজন ও বিদ্দজনের অন্তরালেই থেকে গিয়েছেন তিনি। অথচ এই অঞ্চলে তিনিই একমাত্র মহিলা সাফাইকর্মী। দারিদ্রতা তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। সরকারি সাহায্যও তিনি তেমন কিছুই পাননি। ভোট আসে, ভোট যায়, প্রতিবারের মতো তিনিও তাঁর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বোতাম টিপে ভোট দেন। অথচ ভোটের পর কেউ আর খোঁজ রাখে না তাঁর।

তিনি নিজে একজন সাফাইকর্মী। অন্যের মল-মূত্র পরিষ্কার করতে হয় নিত্যদিন। অথচ অর্থের কারণে তাঁর নিজের বাড়িতে আজও জোটেনি কোনও শৌচালয়। বাড়ির মহিলাদের লজ্জার মাথা খেয়ে খোলা স্থানেই সারতে হয় শৌচকর্ম। এমনকি বাড়িতে কোনও পানীয় জলের ব্যবস্থাও নেই। দীর্ঘদিন বিধবা হলেও আজও পাননি বিধবা ভাতা। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছেন অনেকবার, সুরাহা হয়নি কিছুই।

Advertisement
Previous articleলাল ধুলোর ঝড়ে একাকী হেঁটে চলেছে পারসিভিয়ারেন্স, খুঁজছে প্রাণ
Next articleভেষজ আবিরের চাহিদা ছিল এবছর বেশ তুঙ্গে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here