এতসবের পরেও গ্রামটির মানুষগুলির দিকে বিশেষ নজর দেয়নি কেউ। বা বলা ভালো, নজর দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেনি কেউ। এখানে অন্যসব সমস্যার মধ্যে ‘স্কুলছুট’-এর সমস্যা অন্যতম। খুব কম বয়সেই ছেলের দল স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তাদের কেউ বা দেখভালের অভাবে বৃথা খেলা করে বা বনের পাখি মেরে সময় নষ্ট করে, কেউ বা সংসারের প্রয়োজনে হাটে পুতুল বিক্রি করতে ছুটে যায়। মূল কথা তাদের লেখাপড়া শেখানোর দিকে নজর দেওয়ার বিশেষ কেউ নেই এখানে। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

মৌমিতা দাস : শান্তিনিকেতনের বনেরপুকুরডাঙা গ্রামটির সঙ্গে হয়তো অনেকেরই পরিচয় রয়েছে। খুব কম পর্যটকই আছেন, যাঁরা শান্তিনিকেতন এসেছেন অথচ বনেরপুকুরডাঙা যাননি। খোয়াই প্রান্তরের শাল বন পেরিয়ে ছোট্ট সুন্দর এই গ্রামটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি পিছিয়ে পড়া আদিবাসী পরিবার। শনিবারের খোঁয়াইয়ের ‘অন্য বনের হাট’-এ এই আদিবাসীদের শিল্প ও সংস্কৃতি মিশ্রিত প্রকৃত গ্রাম দেখতে অনেকেই হাজির হন। গ্রামের প্রত্যেকটি মাটির বাড়ির দেওয়াল সাজানো হয়েছে আদিবাসী রমণীদের সুপরিকল্পিত চিত্রকল্পে। যা ‘দেওয়াল চিত্র’ নামেই বেশি পরিচিত।
শান্তিনিকেতনে এই গ্রামীণ নান্দনিক সৌন্দর্যের জন্যই এখানে ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ও পর্যটকদের ভিড় জমে প্রায় সারা বছরই। এককালে জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক ‘ইষ্টিকুটুম’-এর অধিকাংশ শুটিংই হয়েছে এখানে। ওই ধারাবাহিকের অন্যতম ‘বাহা’ চরিত্রটির নামানুসারে এই গ্রামটি ‘পলাশবনি’ বা ‘বাহামনি’ গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে।
তবে এতসবের পরেও গ্রামটির মানুষগুলির দিকে বিশেষ নজর দেয়নি কেউ। বা বলা ভালো, নজর দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেনি কেউ। এখানে অন্যসব সমস্যার মধ্যে ‘স্কুলছুট’-এর সমস্যা অন্যতম। খুব কম বয়সেই ছেলের দল স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তাদের কেউ বা দেখভালের অভাবে বৃথা খেলা করে বা বনের পাখি মেরে সময় নষ্ট করে, কেউ বা সংসারের প্রয়োজনে হাটে পুতুল বিক্রি করতে ছুটে যায়। মূল কথা তাদের লেখাপড়া শেখানোর দিকে নজর দেওয়ার বিশেষ কেউ নেই এখানে।
তাই তাদেরকে শিক্ষার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে প্রায় এক বছর আগেই এগিয়ে এসেছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দুই শিক্ষার্থী প্রকাশ হালদার ও দৈবকি মন্ডল। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অবসর সময়টুকু অন্য কোথাও ব্যয় না করে এই ‘স্কুলছুট’ ছেলেমেয়েদের শিক্ষার কাজে সময় দেবেন।
আর এই ভাবনাতেই শুরু হয়েছিল তাঁদের ছোট্ট একটি পাঠশালা। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সোনাঝুড়ি শিক্ষানিকেতন’। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থী সুস্মিতা দাস। এছাড়াও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রদীপ সিকদার ও সুজিত পাল। এই পাঠশালাতে এখন শুধু লেখাপড়ায় নয়, শেখানো হয় নাচ, গান, ছবি আঁকা ও খেলাধুলা।
বর্তমানে সুজিত পালের সাহায্যার্থে এই পাঠশালার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘অমৃতা সিয়াটেল’ নামের একটি আমেরিকান সংস্থা। যারা সাধারণত কাজ করে থাকে বাচ্চাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে। এছাড়াও কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়ার কাজও তারা করে থাকে। এক্ষেত্রে ‘অমৃতা সিয়াটেল’-এর সদস্য শর্মিলা পাল, সম্পা পাল ও দেবলা অধিকারীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। কারণ তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই বিভিন্ন দিক থেকে উপকৃত হয়েছে বনেরপুকুরডাঙার এই ছোট্ট পাঠশালাটির ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা।