বিরল পুজো : আবাডাঙা গ্রামে একই সঙ্গে পূজিত হয় লক্ষ্মী-সরস্বতী

Advertisement
প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই রীতিতেই পুজো হয়ে আসছে এই পরিবারে। পুজোর সূচনা করেন রামলাল মুখোপাধ্যায়। যিনি ছিলেন গুনুটিয়ার রেশমকুটির খাস দেওয়ান। সে সময় জন চিফের এই রেশমকুটি ছিল সমগ্র ভারতের মধ্যে অন্যতম সেরা একটি রেশম কুটি। রামলাল এই কুটির দেওয়ান হিসাবে বরাবরই ছিলেন ব্রিটিশ সাহেবদের অতি বিশ্বস্ত। ফলে তিনি প্রভূত অর্থ, যশ, খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। এই সময় একবার তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁর নিজের বাড়িতে একই সঙ্গে ধন, সমৃদ্ধি ও বিদ্যার দেবীর আরাধনা করবেন তিনি। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি

বিরল পুজো : আবাডাঙা গ্রামে একই সঙ্গে পূজিত হয় লক্ষ্মী-সরস্বতী

সুজয় ঘোষাল : কথিত রয়েছে। ‘রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী’। অর্থাৎ যে রমণীর মধ্যে এই দুই দেবীর বৈশিষ্ট্য বর্তমান, তার সংসার কখনওই অসুখী হতে পারে না। যদিও লক্ষ্মী ও সরস্বতী-কে কখনওই একই সময়ে পুজো করা হয় না। ধনের দেবী লক্ষ্মী পূজিত হয় শারদীয় পূর্ণিমাতে। আর বাগদেবী সরস্বতীকে পুজো করা হয় মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে।

পুরাণ মতে, একবার লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মধ্যে চরম বিবাদ বাধলে, মর্ত্যধামে তাদের আরাধনার সময় সূচিও পালটে যায়। এমনকি তাদের এই বিবাদের ঢেউ মানুষের সংসার জীবনেও প্রবেশ করতে দেখা গিয়েছে। সাধারণ বাঙালি গৃহস্থ পরিবারে আজও ধন ও বিদ্যার সামগ্রী একত্রে রাখার নিয়ম নেই, পাছে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর কোপে পড়ে অমঙ্গল হয়।

তবে বীরভূম জেলার লাভপুর ব্লকের আবাডাঙা গ্রামের মুখোপাধ্যায় বাড়িতে অবশ্য লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে একত্রে বসিয়ে একই দিনে একই সময়ে আরাধনা করার চল রয়েছে। যা সম্পূর্ণ একটি বিপরীত ধারা বলেই মনে করেন স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এই পুজোর সময় সূচি মেনে নেওয়া হয়েছে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীকে। অর্থাৎ সরস্বতী পুজোর দিনেই লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে বীরভূম জেলার এই একটি মাত্র গ্রামেই একত্রে একই দিনে আরাধনা করা হয়।

কেন এই বিপরীত ধারা? মুখোপাধ্যায় পরিবার সূত্রে জানা গেল, প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই রীতিতেই পুজো হয়ে আসছে এই পরিবারে। পুজোর সূচনা করেন রামলাল মুখোপাধ্যায়। যিনি ছিলেন গুনুটিয়ার রেশমকুটির খাস দেওয়ান। সে সময় জন চিফের এই রেশমকুটি ছিল সমগ্র ভারতের মধ্যে অন্যতম সেরা একটি রেশম কুটি। রামলাল এই কুটির দেওয়ান হিসাবে বরাবরই ছিলেন ব্রিটিশ সাহেবদের অতি বিশ্বস্ত। ফলে তিনি প্রভূত অর্থ, যশ, খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। এই সময় একবার তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁর নিজের বাড়িতে একই সঙ্গে ধন, সমৃদ্ধি ও বিদ্যার দেবীর আরাধনা করবেন তিনি। ঠিক তখন থেকেই শুরু হয়েছিল একত্রে ও একই দিনে লক্ষ্মী-সরস্বতীর আরাধনা। পরে লক্ষ্মী-সরস্বতী সঙ্গে যুক্ত হয় জয়া ও বিজয়া।

এখানে প্রতিমার ধরণও কিছুটা আলাদা। লক্ষ্মী ও সরস্বতী এখানে বাহনবিহীন। অর্থাৎ চির পরিচিত লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা ও সরস্বতীর রাজহাঁস এখানে দেবী দ্বয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। এছাড়াও প্রতিমার পিছনে থাকে হাতে আঁকা চালচিত্র। সাধরণত দুর্গা পুজোতেই পিছনের আচ্ছাদন রূপে অর্ধাচন্দ্রকৃতি চালচিত্র ব্যবহার করা হয়। ঠিক একই রকমভাবে এই পুজোতেও ওইরূপ দৃষ্টান্ত রাখা হয়েছে।

মুখোপাধ্যায় বাড়ির অন্যতম সদস্য ও পুরোহিত অর্ণব মুখোপাধ্যায় জানালেন, “আমাদের বাড়ির এই পুজোর সঙ্গে ঐতিহ্য মিশে রয়েছে। তিন দিন নিয়ম নিষ্ঠা মেনে বৈষ্ণব মতে এই পুজো করা হয়ে থাকে। পূর্বে এই পুজো দেওয়ান বাড়ির পুজো নামে পরিচিত ছিল। রামলাল মুখোপাধ্যায় ব্রিটিশ সাহেবদের সুনজরে আসার ফলে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল।”

সরস্বতী পুজো সাধারণত মাঘ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিকল্পের ধারা মেনে এবছর ফাল্গুনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই পুজো। আর এবছর মুখোপাধ্যায় পরিবারের এই বিপরীত ধারার সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব পেয়েছেন বজ্রদুলাল মুখোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, “বর্তমানে এই পুজো চার শরিকের পুজো। বনেদি রীতি অনুযায়ী পরম্পরাগতভাবে ছয় পুরুষ ধরে এই পুজো চলে আসছে। গ্রামের মৃৎশিল্পী জগন্নাথ ও অনাথবন্ধু কুন্ডু বংশপরম্পরায় প্রতিমা নির্মাণ করেন। আমাদের মুখোপাধ্যায় বাড়িতে দুর্গাপুজোও হয়। কিন্তু তার থেকেও এই সরস্বতী পুজো অনেক বেশী পুরনো।”

বিদ্যা ব্যতীত নাকি সহজে ধন লাভ হয় না। তাই বাগদেবীর আরাধনা যর্থাথ হলেই সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর কৃপা পাওয়া যায়। এই আপ্তবাক্য-কে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা নিজের নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপাতত সেসবের নিকটে না গিয়ে পুজোর দিনগুলি আবাডাঙা গ্রামের বাসিন্দারা মেতে ওঠেন সম্পূর্ণ অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে।

Advertisement
Previous articleসবুজ পৃথিবীর বনভূমি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ধূসর মরুভূমির দিকে
Next articleস্বাধীনতার পর দেশে এই প্রথমবারের জন্য ফাঁসি হতে চলেছে কোনও মহিলার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here