আমোদপুর হাটতলার এই ‘প্রাণ-চঞ্চলা’ হাটটি টিকে ছিল একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে। ২০০০ সাল থেকে ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে এই হাট। প্রায় সেই সময় থেকেই হাটের বিক্রেতারা একে একে আমোদপুর স্টেশনের পশ্চিম চত্বরে তাঁদের দোকান সরাতে শুরু করে। আর এখন সেই হাটের অস্তিত্ব শুধু ‘হাটতলা’ নামটির মধ্যেই জীবিত রয়েছে। বাকিটা হয়ে গিয়েছে ইতিহাস। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

সুজয় ঘোষাল ও বিশ্বজিৎ ঘোষ : ‘হাট’ বলতে সাধারণত প্রকাশ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের কোনও স্থানকে বোঝায়। তবে এই হাট বাজারের মতো প্রতিদিন উন্মুক্ত থাকে না। সপ্তাহের নির্দিষ্ট কোনও দিনে বসে। কোনও গ্রাম বা কোনও অঞ্চলকে কেন্দ্র করে হাট বসতে পারে। প্রথম অবস্থায় ছোটো থাকলেও সেই হাটের পরিধি পরে বাড়তেও পারে।
নির্দিষ্ট দিনে বসা সেই হাটগুলি প্রায় সারাদিনই থাকে চঞ্চল। মানুষের যাওয়া-আসা, কেনা-বেচা, হৈ-হট্টগোলের শেষ থাকে না। তবে সন্ধ্যা নামলেই হাটের চিত্র পুরোপুরি বদলে যায়। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে পরিবেশ। যত্রতত্র পড়ে থাকে হাটের অবশেষ। হাটের এই বিষয়গুলি কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত তাঁর “হাট” কবিতায় অদ্ভুত সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন।
বীরভূম জেলার আমোদপুরের হাটতলার ছবিও এক সময় ঠিক এই রকমই ছিল। এখানে সপ্তাহে দু’দিন বসত হাট। হাটবার অর্থাৎ প্রতি বুধ ও রবিবারের দিনগুলিতে এই অঞ্চলটি অগণিত ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে এক অন্যরকম চিত্রে পরিণত হত। তবে সময়ের বিবর্তনে আজ শুধু ‘হাটতলা’ নামটিই অবশিষ্ট রয়েছে। বাকি পুরোটাই ইতিহাসের গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছে।
আমোদপুরের এই হাটতলায় হাট বসা শুরু হয়েছিল ১৮৭৮-১৮৭৯ সাল নাগাদ। তখন হাটতলার এই স্থানটি ছিল মুরারয়ের দত্ত পরিবারের অংশ বিশেষ। অনেক পরে এই হাটতলার অংশীদার হয়েছিলেন তিনজন অনিল মন্ডল, নিমাই নন্দন রায়, রজতভূষণ দত্ত। রজতভূষণ দত্তের অংশের আবার দুটি ভাগ ছিল। সেই ভাগের অংশীদার ছিলেন ফণিভূষণ দত্ত ও মণিভূষণ দত্ত। পরে এই হাটতলার একটি অংশ চলে যায় আমোদপুর গ্রাম পঞ্চায়েত-এর হাতে।
এই হাটে বিক্রতাদের কাছ থেকে তোলা আদায়ের ব্যবস্থাও ছিল। তবে প্রথম দিকের তোলা আদায়ের হিসাব কীভাবে করা হত, তা আর জানা যায় না। স্বাধীনতার পরবর্তীকালের হিসাবে হাটের তোলা আদায় যদি ১০০ পয়সা ধরা হয়, তবে অনিল মন্ডলের অংশ ছিল ৪২ পয়সা, রজতভূষণ দত্তের ছিল ৩০ পয়সা এবং বাকি ২৮ পয়সার মালিকানা ছিল পঞ্চায়েত ও নিমাই নন্দন রায়ের। হাটে বসার জন্য বিক্রেতাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে তোলা আদায়ের জন্য আবার বেশ কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হত। এই রকম রজতভূষণ বাবুর জায়গার তোলা আদায় করতেন বিজয় গোপাল মন্ডল।
তখন হাটতলার এই হাট ছিল পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ হাট। আশে-পাশের কুসুমযাত্রা, সিউড়, ভ্রমরকোল, ক্ষতিপুর, হাতিয়া, নানুবাজার, সাংড়া, নিরিশা, অমরপুর, সাঙুলডিহি, কাগাস, জুনেদপুর প্রভৃতি গ্রামের মানুষদের এই হাটে ছিল নিত্য যাতায়াত। সেদিক থেকে আমোদপুরের এই হাট অনেকটা সেতুবন্ধনের কাজও করত ওই সমস্ত গ্রামগুলির মধ্যে।
এই হাটে তিনদিক থেকে প্রবেশ করা যেত। উত্তর দিকের প্রবেশ মুখের দোকানিরা নিয়ে বসতেন মনীষীদের ছবি, বই, খাতা, পেন, গামাছা, পান-বিড়ি-সিগারেট ইত্যাদি। দক্ষিণ দিকটি (বর্তমান মন্ডলপাড়া) ছিল মূলত সবজি বিক্রেতাদের দখলে। এছাড়াও এই অংশে কুমোরেরা তাঁদের মাটির তৈরি হাড়ি, হোল্লা, মালসা, পাতনা প্রভৃতি নিয়েও বসতেন। সেই সঙ্গে তালপাতার পাখা ও তালাই নিয়ে বসতেন বেশ কয়েকজন বিক্রেতা। হাটতলার পূর্বদিকের প্রবেশ পথের ধারে ছিল ‘মুরমুড়ি’ নামের একটি পুকুর। পুকুর সংলগ্ন এই অংশে বসত বিভিন্ন রকমের খাবারের দোকান। আর পশ্চিমদিকের বিক্রেতারা নিয়ে বসতেন চুড়ি, চাবকি, মাছ ধরার সরঞ্জাম, তোগি, বঁড়শি, ঝোপা, শাঁখা-পলা ইত্যাদি।
আমোদপুর হাটতলার এই ‘প্রাণ-চঞ্চলা’ হাটটি টিকে ছিল একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে। ২০০০ সাল থেকে ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে এই হাট। প্রায় সেই সময় থেকেই হাটের বিক্রেতারা একে একে আমোদপুর স্টেশনের পশ্চিম চত্বরে তাঁদের দোকান সরাতে শুরু করে। আর এখন সেই হাটের অস্তিত্ব শুধু ‘হাটতলা’ নামটির মধ্যেই জীবিত রয়েছে। বাকিটা হয়ে গিয়েছে ইতিহাস।
কয়েক বছর আগেও এই হাটতলার পুরনো হাটে কুমোরদের তাঁদের পসরা নিয়ে বসতে দেখা যেত। এখন তাঁরাও আর বসেন না। তবে একাই হাটের সঙ্গী হয়ে আজও নিজের নির্দিষ্ট স্থানটিতে পসরা সাজিয়ে বসেন ৭০ বছরের শংকরী দেবনাথ।