ঘাস শিল্প একটি ব্যতিক্রমী ধারার শিল্প হওয়ায় এর চাহিদাও নেহাত কম নয়। শান্তিনিকেতন অঞ্চলে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে এই ঘাস শিল্প সামগ্রীর কদরও রয়েছে যথেষ্ট। এই সুযোগে বল্লভপুরের হস্তশিল্পীরা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে এগুলিকে বাজারজাত করে থাকেন। যার অধিকাংশই পৌঁছে যায় শান্তিনিকেতন ও তৎসংলগ্ন সোনাঝুরির হাট এবং ‘আমার কুটির’-এ। বিপনন ব্যবস্থার অভাবে এই উদীয়মান ঘাসশিল্প যাতে হারিয়ে না যায় এবং পর্যটকদের নজরে এসে দ্রুত যাতে সমাদৃত হয়, সেজন্য ‘আমার কুটির সোসাইটি ফর রুরাল ডেভলপমেন্ট’ বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছে। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

সুজয় ঘোষাল : বীরভূম জেলার বোলপুর-শান্তিনিকেতনের অনতিদূরে ছোট্ট, সুন্দর, সুবজঘেরা গ্রাম বল্লভপুর। এই বল্লভপুর গ্রামকে কুটির শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান বলা হয়ে থাকে। কারণ শান্তিনিকেতন ঘরনার বাটিক, চর্ম, কাঁথা স্টিচ সহ বিভিন্ন কুটির শিল্প গড়ে উঠছে এই গ্রামটিকে কেন্দ্র করে। আর এই সমস্ত কুটির শিল্পের মধ্যে ধীরে ধীরে জনমানসে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে উদীয়মান ‘ঘাস শিল্প’।
বল্লভপুর গ্রামটির একেবারেই পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে কোপাই বা শাল নদী। ঘাস শিল্পের রসদ জোগাতে এই নদীটির ভূমিকা যথেষ্ট। কারণ নদীর দুই তীর ঘেঁষে প্রায় সারা বছরই যততত্র ছড়িয়ে থাকে ‘কাশ’ জাতীয় ঘাস। হস্তশিল্পীরা তাঁদের ঘাস শিল্পের জন্য এই জাতের ঘাসই এখান থেকে সংগ্রহ করে থাকেন।
যদিও বীরভূম জেলার মূয়রাক্ষী, বক্রেশ্বর, দ্বারকা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতেও এই ধরণের ঘাসের প্রাচুর্য রয়েছে, কিন্তু সেই সব নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলির কোনওটিতেই প্রায় এই ঘাস শিল্প গড়ে উঠতে দেখা যায় না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলা চলে শুধুমাত্র বল্লভপুরকেই। বর্তমানে এই গ্রামের প্রায় ৩০-৪০ জন মহিলা এই ব্যতিক্রমী শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেদের স্বনির্ভর করে তুলেছেন।
ঘাস শিল্পের সবচেয়ে বেশি বিকাশ ঘটেছে এই গ্রামটির রাইপাড়া ও দাসপাড়ায়। এখানকার মহিলারা কোপাই নদীর চর থেকে লম্বা লম্বা কাশ গুল্মকে মাপ করে কেটে বাড়িতে নিয়ে এসে বেশ করে রোদে শুকিয়ে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলেন। তারপর নিপুণ বুননে রূপ দেন একের পর এক ব্যবহার উপযোগী সৌখিন দ্রব্যে। সেগুলির মধ্যে অবশ্যই নজরে পড়বে ফুলের সাজি, সবজি-ফলের ঝুড়ি, ফুলদানি, কলমদানি, লক্ষ্মীর ভাঁড়, চায়ের ট্রে, গয়নার বাক্স প্রভৃতিকে।
ঘাস শিল্প একটি ব্যতিক্রমী ধারার শিল্প হওয়ায় এর চাহিদাও নেহাত কম নয়। শান্তিনিকেতন অঞ্চলে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে এই ঘাস শিল্প সামগ্রীর কদরও রয়েছে যথেষ্ট। এই সুযোগে বল্লভপুরের হস্তশিল্পীরা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে এগুলিকে বাজারজাত করে থাকেন। যার অধিকাংশই পৌঁছে যায় শান্তিনিকেতন ও তৎসংলগ্ন সোনাঝুরির হাট এবং ‘আমার কুটির’-এ। বিপনন ব্যবস্থার অভাবে এই উদীয়মান ঘাসশিল্প যাতে হারিয়ে না যায় এবং পর্যটকদের নজরে এসে দ্রুত যাতে সমাদৃত হয়, সেজন্য ‘আমার কুটির সোসাইটি ফর রুরাল ডেভলপমেন্ট’ বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত পিঙ্কি রাই জানালেন, “আমরা ২০০০ সাল থেকে কাশের তৈরী বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী আমার কুটিরে নিয়ে আসছি। আমার কুটির ছাড়াও কর্মতীর্থ ও খোয়াইয়ের হাটে এই সামগ্রীর বেশ ভালোই বাজার পাই।”
রাইপাড়া ও দাসপাড়ার ঘাসের হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের কাছ থেকে জানা গেল, এই হস্তশিল্প তৈরী করতে শ্রম, ধৈর্য ও কৌশলের বিশেষ প্রয়োজন। পুঁজির প্রয়োজন হয় কম। সাধারণত চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাস নদীর ধার থেকে কাশ কেটে আনার উপযুক্ত সময়। কেউ বা এই কাশ কাটার জন্য মুনিশেরও ব্যবস্থা করে থাকেন। তখন কিছু অর্থ খরচ হয় বইকি। তবে একবার প্রয়োজন মতো কাশ কেটে আনা সম্ভব হলে প্রায় সারা বছর ধরেই ঘরে বসে সেই কাশ দিয়ে ব্যবহার উপযোগী সৌখিন সামগ্রী তৈরি করা যায়।
দাসপাড়ার লীলা দাস জানালেন, “আমি বিগত ৩৫ বছর ধরে ঘাসের হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এই শিল্পের জন্য কাঁচামালের খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু কাশ ও খেজুর পাতা সংগ্রহ করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে কাশ বনে ঢুকে কাশ কাটা খুব কষ্টকর। আমার কুটিরে প্রায় ২০ বছর ধরে এই হস্তশিল্পের জোগান দিয়ে আসছি।”