১৯৩৭ সাল নাগাদ আন্দামান থেকে রাজবন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সারা দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। জেলমুক্ত হয়ে বিপ্লবীদের অনেকেই ছিলেন গৃহহারা, ভগ্নস্বাথ্য ও অনাহারী। সেই সময় সুষেনবাবু তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আমার কুটির তোমাদের সকলের কুটির। তোমাদের খাওয়া-পরা, অসুখ-বিসুখ সহ সমস্ত কিছুর দায়িত্ব আমার কুটিরের। তোমরা মনের আনন্দে দেশের সেবা করে যাও”। ক্রমশ এই ‘আমার কুটির’ গঠনমূলক কাজের প্রানকেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে বৈপ্লবিক চিন্তাধারার প্রেরণাস্থল হয়ে ওঠে। – ছবি : জনদর্পণ প্রিনিধি |

বিজয় ঘোষাল : বীরভূম জেলার কুটির শিল্পের জাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় নাম ‘আমার কুটির’। বহু আঁকাবাঁকা পথ হেঁটে, সহস্র মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এই ‘আমার কুটির সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলাপমেন্ট’। আর এর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এক বিপ্লবী যুবকের স্বপ্ন ও সাধনা। তিনি সুষেন মুখোপাধ্যায়।
সমগ্র দেশব্যাপী যখন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে গাঁধী নির্দেশিত অসহযোগ আন্দোলনে উত্তপ্ত, তার প্রভাব পড়েছিল এই বীরভূম জেলাতেও। ১৯২৩ সালে গাঁধীজি একবার রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। সেই সময় তাঁর নির্দেশ ছিল ব্রিটিশদের অসহযোগিতা করার জন্য প্রত্যেক দেশবাসীর কর্তব্য চরকায় সুতো কাটা। কিন্তু চব্বিশ পরগনার গুস্তিয়া গ্রামের বিপ্লবী সুষেন মুখোপাধ্যায় এই বিষয়টিকে তেমন প্রাধান্য দিতে চাননি। তিনি গাঁধীজির সঙ্গে আলোচনায় বসার উদ্দেশ্যে তখন শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। কিন্তু গাঁধী দর্শনের সৌভাগ্য সেবার তাঁর হয়নি।
ততদিনে ‘গুরুদেব’-এর পল্লীপুর্নগঠনের স্বার্থক প্রয়াস রূপায়িত হয়েছে। শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছে শিল্পভবন, বিচিত্রাকারুসংঘ, স্বাস্থ্যসমবায়। গুরুত্ব পেয়েছে পরিবেশ শিল্পের নানান দিক। গুরুদেবের গ্রামসংগঠনের এই সার্থক রূপায়ণ সুষেন মুখোপাধ্যায়কে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেসময় তিনি সুরুলের জমিদার বংশের ছেলে আশ্বিনী কুমার সরকারের সহযোগিতায় শান্তিনিকেতন থেকে ৫ কিলোমিটারের ব্যবধানে বল্লভপুর গ্রামের কোপাই নদীর ধারে প্রায় ১০০ একর জমির উপর একটি সুতিবস্ত্র ছাপার কারখানা স্থাপন করেন। তার নাম দিলেন ‘আমার কুটির’।
‘আমার কুটির’-এর নামকরণের পিছনেও ছিল যথার্থ যুক্তি। ‘আমার’ শব্দের মাধ্যমে নৈর্ব্যক্তিতা আসে, আসে আপন, নিঃস্বার্থ স্বকীয়তা, দায়বদ্ধতা, আপন কর্তব্য ও অপরিত্যজ্য এক দায়িত্ব। যার মূল অর্থ যে কেউ এই স্থানটিকে ‘আমার’ করে নিতে পারবে। এভাবেই সংসার বিমুখীতা, ভবঘুরে, অল্প শিক্ষিত এই মানুষটি ‘আমার কুটির’ গঠনের মাধ্যমে বৈদেশিক অবাধ প্রতিযোগিতার হাত থেকে দেশীয় গ্রামীণ শিল্পকে বাঁচিয়ে তার অবয়বকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। এর সঙ্গে গুরুত্ব পেয়েছিল গ্রাম উদ্যোগ, গ্রাম সংগঠন ও গ্রামোন্নয়ন।
১৯২৮ সাল নাগাদ বৈপ্লবিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য ‘আমার কুটির’-কে বেআইনি ঘোষণা করে বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ সরকার। সেই সঙ্গে সুষেন মুখোপাধ্যায়ও গ্রেপ্তার হন। পরে ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি আবার ‘আমার কুটির’-এ ফিরে আসেন।
এই সময় ‘আমার কুটির’-এ এসে যুক্ত হলেন মেছুয়াবাজার বোমা মামলার (১৯২৯) আসামী পান্নালাল দাশগুপ্ত। কালিম্পং জেলে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বিপ্লবী সুষেণবাবুর। জেলে থাকাকালীন পান্নালালবাবু একবার যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরে রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শে অনুপ্রাণীত সুষেণবাবুর শুশ্রুয়ায় সেবার সুস্থ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তিনি। এখানে উল্লেখ করতে হয়, শুধু পান্নালালবাবু নন, তাঁর সেবা পাওয়ার সৌভাগ্য ঘটেছিল মনোরঞ্জন দত্ত সহ আরও অনেকেরই।
সুষেন মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে পান্নালাল দাশগুপ্তের অভিমত ছিল, “সুষেনবাবু একজন অদ্ভূত চরিত্রের ব্যক্তি। বড়ো বড়ো দু’টি দোকান পরিচালনা করতেন। ব্যবসা করতেন বিদেশি জার্মান ফোটোগ্রাফির। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর অনেক পালিত ছেলে-মেয়ে ছিল। তিনি তাদের নানা ধরনের কাজকর্ম ও নিজের ব্যবসায় বসিয়ে দিতেন”। (ভাবনা চিন্তা, পৃ : ৭৫)।
১৯৩৭ সাল নাগাদ আন্দামান থেকে রাজবন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সারা দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। জেলমুক্ত হয়ে বিপ্লবীদের অনেকেই ছিলেন গৃহহারা, ভগ্নস্বাথ্য ও অনাহারী। সেই সময় সুষেনবাবু তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আমার কুটির তোমাদের সকলের কুটির। তোমাদের খাওয়া-পরা, অসুখ-বিসুখ সহ সমস্ত কিছুর দায়িত্ব আমার কুটিরের। তোমরা মনের আনন্দে দেশের সেবা করে যাও”। ক্রমশ এই ‘আমার কুটির’ গঠনমূলক কাজের প্রানকেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে বৈপ্লবিক চিন্তাধারার প্রেরণাস্থল হয়ে ওঠে।
বর্তমানে আমার কুটির একটি সার্থক প্রতিষ্ঠান। কুটিরের কোনও ব্যক্তিগত মালিকানা নেই। প্রতিষ্ঠাতার ভাবনাকে পাথেয় করে, কর্মীবৃন্দদের প্রচেষ্টায় উত্তরণের পথে এগিয়ে চলেছে এটি। ১০০ জনেরও বেশি কর্মী এখানে যুক্ত আছেন এখন। ইতিমধ্যে ‘আমার কুটির’ বীরভূম জেলা তথা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে নিয়েছে। বাইরে থেকে যেসব পর্যটকরা শান্তিনিকেতনে ভ্রমণ করতে আসেন, তারাও একবার হলেও ‘আমার কুটির’-এ বেড়াতে আসেন। ‘আমার কুটির’-এ রয়েছে বীরভূমের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত একটি সংগ্রহশালা। যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন যত্ন করে রাখা হয়েছে।
তবে পরিশেষে বলতেই হয়, আজ ‘আমার কুটির’-এর যা কিছু উন্নতি, তার সবই প্রায় সম্ভব হয়েছে সুষেন মুখোপাধ্যায়ের জন্যে। এই মানুষটির সংগ্রামময় জীবনের সার্থক ফসল ও তাঁর মানসকন্যা ‘আমার কুটির’ আজীবন দাঁড়িয়ে থাকবে মাথা উঁচু করে।