সতীন্দ্রমোহনের পর ১৮২১ সাল নাগাদ জমিদারির পদ পান তাঁর পুত্র যতীন্দ্রমোহন রায়। মূলত তাঁর সময়কেই এই জমিদার বংশের স্বর্ণযুগ বলা চলে। বিভিন্ন দিক থেকে তিনি সাহোড়া গ্রামের প্রভূত উন্নতি ঘটিয়েছেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন দক্ষ সংগীতজ্ঞ। তাঁর সময়ে একবার এই সাহোড়া গ্রামে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া থেকে বিখ্যাত বাউল সাধক লালন সাঁই ফকিরও এসেছিলেন দেহতত্ব চর্চার জন্য। এছাড়াও যতীন্দ্রমোহন রায় এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন একটি গ্রামীণ পাঠশালা। চিৎকিসার জন্য নিয়োগ করেন একজন গ্রামীণ বৈদ্য। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল : মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা ব্লকের সাহোড়া একটি অতিপ্রাচীন গ্রাম। প্রাচীনত্বের প্রমাণ হিসাবে এখানে পাল যুগের বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির আজও অক্ষত রয়েছে। জনশ্রুতি বলছে, রাজা শকট-এর নামানুসারে গ্রামটির নাম হয় ‘সাহোড়া’। গ্রামটির দক্ষিন-পশ্চিম দিকে একটি সুবিশাল প্রাচীন জমিদার বাড়ির অস্তিত্ব আজও রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে এটি এখন ‘বাবু বাড়ি’ নামে পরিচিত।
পুরনো নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে, সতেরশো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই সাহোড়া গ্রামের (তৎকালীন বীরভূম জেলার অন্তর্গত) জমিদার ছিলেন আনন্দমোহনী দেবী নামের একজন বীরাঙ্গনা মহিলা। সম্ভবত তাঁর পিতা তৎকালীন বাংলার গর্ভনর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের কাছ থেকে এই অঞ্চলে স্থায়ী জমিদারির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এই সময়ে আনন্দমোহনী দেবী সাহোড়া গ্রামে বেশ কয়েকটি মন্দির স্থাপন করেন, যার মধ্যে অন্যতম গ্রামটির উত্তর-পূর্ব কোণের সকটেশ্বর শিবমন্দির। ঐতিহাসিক দিক থেকে এই মন্দিরগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।
আনন্দমোহনী দেবীর পর জমিদারির দায়িত্ব পান তাঁর কন্যা নিত্যকামিনী দেবী। কিন্তু তাঁর সময়ে সংগঠিত একাধিক বিশৃঙ্খলা তিনি কোনওভাবেই দমন করতে পারেননি। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই তিনি এই সাহোড়া গ্রামের জমিদারির দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন তাঁরই দৌহিত্র সতীন্দ্রমোহন রায়-এর হাতে। সতীন্দ্রমোহন রায় তখন ছিলেন বর্ধমান জেলার দিকনগর অঞ্চলের জমিদার।
সতীন্দ্রমোহনের পর ১৮২১ সাল নাগাদ জমিদারির পদ পান তাঁর পুত্র যতীন্দ্রমোহন রায়। মূলত তাঁর সময়কেই এই জমিদার বংশের স্বর্ণযুগ বলা চলে। বিভিন্ন দিক থেকে তিনি সাহোড়া গ্রামের প্রভূত উন্নতি ঘটিয়েছেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন দক্ষ সংগীতজ্ঞ। তাঁর সময়ে একবার এই সাহোড়া গ্রামে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া থেকে বিখ্যাত বাউল সাধক লালন সাঁই ফকিরও এসেছিলেন দেহতত্ব চর্চার জন্য। এছাড়াও যতীন্দ্রমোহন রায় এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন একটি গ্রামীণ পাঠশালা, চিৎকিসার জন্য নিয়োগ করেন একজন গ্রামীণ বৈদ্য।
যতীন্দ্রমোহনের পর জমিদারির দায়িত্ব পান বাবু জনরঞ্জন রায়। তিনিও গ্রামের প্রভূত উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করেন। ১৮৮৫ সালে সাহোড়া মাইনর বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন তিনি। স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের জন্যও তিনি ছিলেন বিশেষ মনোযোগী। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ও। পরে তিনি বীরভূম জেলার বোলপুর অঞ্চলের ভুবনডাঙার চার বিঘা জমি শিক্ষার প্রসারের জন্য দান করেছিলেন বিশ্বভারতীকে। সেসময়ে ভুবনডাঙা ছিল ভুবন বাগদির মালিকানাধীন। এই ভুবন বাগদি ছিলেন সাহোড়ার জমিদার বাড়ির একজন রনকৌশলী লাঠিয়াল।
এছাড়াও তিনি স্থাপন করেছিলেন ‘হেমাঙ্গীনি দাতব্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র’ নামে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র। বাংলার পুরাতন ঐতিহ্য লাঠি খেলাকে টিকিয়ে রাখতে গ্রামের ডোম ও ভল্লা সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি রায়বেঁশে দল গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তার আমলে সাহোড়া গ্রামের বিখ্যাত দুই কুস্তিবিদ রামপতি ও কুমারিশ ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেস গিয়েছিলেন বাংলার প্রতিনিধি হিসাবে কুস্তিচর্চা তুলে ধরতে।
জনরঞ্জনের পর জমিদারির হাল ধরেন পুত্র মহিমারঞ্জন রায়। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী ভারতীয় বিপ্লবী। কৃষ্ণনগরে নীলবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে একবার গ্রেপ্তারও হন তিনি। তিনিও ছিলেন একজন প্রজাদরদী জমিদার। সাহোড়া উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য তিনি ১৪ বিঘা জমি দান করেছিলেন। মহিমারঞ্জনের পর জমিদারির দায়িত্ব নেন সুধীররঞ্জন রায়। ইনি-ই ছিলেন সাহোড়া গ্রামের শেষ জমিদার।
ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো এই তথ্যচিত্র এবং তথ্য। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া ঘটনা গুলো আবার প্রাণ নিয়ে ফিরবে পাঠকের মনে।