উঠে গিয়েছে হাট, তবু আজও হাটতলায় একাই দোকান সাজান শঙ্করী দেবী

Advertisement
চেনা হাটের ছবিটা পালটে গিয়েছে প্রায় ৩০ বছর হল। তবুও ৮০ বছরের শঙ্করী দেবী আজও ভুলতে পারেননি সেই হাটের কথা। আর তাই রবি ও বুধ সপ্তাহের এই দুই দিন চুড়ি, চাপড়ি, মেয়েদের চুলের ফিতে, কার, শাখা, সিঁদুর, পলা, শিশুদের হাতের বালা, মাদুলি, কাঠের চিরুনি, লেচি, হরিতকি, ত্রিফলা, রুদ্রাক্ষ, মালা, পুঁথি, কড়ি, যাঁতি প্রভৃতি নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসেন হাটতলা প্রাঙ্গণে। বিক্রির দীর্ঘ অপেক্ষায় কেটে যায় তার সারাটা দিন। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি

উঠে গিয়েছে হাট, তবু আজও হাটতলায় একাই দোকান সাজান শঙ্করী দেবী
উঠে গিয়েছে হাট, তবু আজও হাটতলায় একাই দোকান সাজান শঙ্করী দেবী 2

সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল : হাট উঠে গিয়েছে প্রায় ৩ দশক আগেই। কিন্তু নামটা আজও হাটতলা-ই থেকে গিয়েছে। সেসময়ে বীরভূম জেলার আমোদপুরের এই হাটতলায় রবি ও বুধ সপ্তাহের এই দুই দিন বেশ জম-জমাট হাট বসত। আনাজপাতি সহ গৃহস্থের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সমস্ত কিছুই বিক্রি হত এই হাটে। পরে সেই হাট তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আমোদপুর রেলস্টেশনের পশ্চিম চত্বরে। এখন এখানেই বসে নিত্যদিনের হাট।

চেনা হাটের ছবিটা পালটে গিয়েছে প্রায় ৩০ বছর হল। তবুও ৮০ বছরের শঙ্করী দেবী আজও ভুলতে পারেননি সেই হাটের কথা। আর তাই রবি ও বুধ সপ্তাহের এই দুই দিন চুড়ি, চাপড়ি, মেয়েদের চুলের ফিতে, কার, শাখা, সিঁদুর, পলা, শিশুদের হাতের বালা, মাদুলি, কাঠের চিরুনি, লেচি, হরিতকি, ত্রিফলা, রুদ্রাক্ষ, মালা, পুঁথি, কড়ি, যাঁতি প্রভৃতি নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসেন হাটতলা প্রাঙ্গণে। বিক্রির দীর্ঘ অপেক্ষায় কেটে যায় তার সারাটা দিন।

শঙ্করী দেবনাথ আজ বয়সের ভারে জীর্ণ। মাথার সমস্ত চুলই প্রায় সাদা, গায়ের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। চোখে কম দেখেন, কানেও কম শোনেন। পরনে সাদা মলিন কাপড়। বয়স আনুমানিক ৮০। বাড়ি তাঁর পুরন্দরপুর অঞ্চলের নিজুড়ি গ্রামে। ১২-১৩ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল বোলপুর অঞ্চলে। কিন্তু অল্পদিনেই তিনি বিধবা হয়ে যান। আবার ফিরতে হয় নিজের গ্রামে। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেও আর কোনও সম্পর্ক থাকেনি তাঁর। বাপের বাড়ির সংসারেও তখন নিত্য অভাব। তবে কারোর বোঝা হয়েও থাকতে রাজী ছিলেন না তিনি। শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন।

প্রথম দিকে তিনি অন্যের বাড়িতে মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করেন। পরে এক আত্মীয়ের পরামর্শে চুড়ি-শাখা-পলা বিক্রির কাজে নেমে পড়েন। তখন থেকেই তাঁর যাওয়া-আসা শুরু আমোদপুর হাটে। তবে আমোদপুর হাট বসত তখন সপ্তাহে দুই দিন (রবিবার ও বুধবার)। বাকি দিনগুলিতে অন্য কোথাও সাজিয়ে নিয়ে বসতেন নিজের দোকান। আর এইভাবেই আমোদপুর হাটে কেটে গিয়েছে তাঁর ৫০টা বছর। এখন শুধু আমোদপুর নয়, পুরন্দরপুরের মঙ্গল ও শুক্রবারের হাটেও তিনি দোকান সাজিয়ে বসেন।

শঙ্করী দেবী নিঃসন্তান। তিনি এখন তাঁর বোনপো পিন্টু দেবনাথের আশ্রয়ে থাকেন। বৃদ্ধা হয়েছেন, তার উপর তিনি বিধবা। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের কোনও সুবিধায় তিনি পান না। পান না বিধবা ভাতা বা বার্ধক্য ভাতাও। তবে তাতে কি! জীবন সংগ্রামে তো আর থেমে থাকলে চলে না।

তাই প্রতি হাটবারের সকালে তাঁকে বেশ তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠতে হয়। তারপর বাস বা টোটো যখন যেটাতে সুবিধা হয় তাতে চেপেই চলে আসেন আমোদপুর হাটতলায়। নিজের হাতে দোকান সাজিয়ে কেটে যায় সারাটা দিন। বিক্রি-বাটড়া যে খুব ভালো হয়, তা কিন্তু নয়। কোনওদিন ৫০-১০০ টাকা। আবার কোনওদিন খালি হাতেই ফিরতে হয় তাঁকে। দোকানের মাল ফুরিয়ে গেলে নিজেই চলে যান বোলপুরের বাজারে। সেখান থেকে নিজেই পছন্দ করে কিনে আনেন দোকানের জিনিসপত্র।

এভাবেই ব্যবসায়ী জীবনের ৫০টা বছর আর নিজের জীবনের ৮০টা বছর পার করে ফেলেছেন শঙ্করী দেবী। জীর্ণ শরীরে এখন তাঁর হাঁটতে বড্ড কষ্ট নয়। কিন্তু নিত্য আসা চাই তাঁর আমোদপুরের হাটে। হাট উঠে গিয়েছে সেই ৩০ বছর আগেই। সরে গিয়েছে আমোদপুর রেলস্টেশন চত্বরে। তবুও হাটের টান যাবে কোথায়! একাই তিনি এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন আমোদপুরের হাটতলাকে, আর সেই সঙ্গে তার হাটকে। বিক্রি হোক বা না হোক, দোকান সাজিয়ে অপেক্ষা করাটাই যেন তাঁর জীবনের একটা অংশ এখন।

Advertisement
Previous articleএই ডিসেম্বরে ঘটবে তিনটি মহাজাগতিক ঘটনা, দেখা যাবে খালি চোখেই
Next articleআসছে পরিযায়ী পাখিরা : দূর দেশ থেকে যেভাবে পথ চিনে আসে তারা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here