জমিদার দেবীদাস ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শিকাড়া কুলীন গ্রামের ঘোষ পরিবারের দুর্গা পুজোর সূচনা করেন। প্রথমে এই পুজো শুরু হয়েছিল গোলপাতার ছাউনি দেওয়া মাটির আটচালা ঘরে। ১৮১০-২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জমিদার কালীপ্রসাদ ঘোষ পাঁচ খিলানযুক্ত দু’মহলা দুর্গা দালান নির্মাণ করেন। যে মন্দিরে আজও দুর্গা পুজো হয়ে চলেছে। পরে কালীপ্রসাদ ঘোষের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জমিদারি ভাগ হয়ে গেলে এই দুর্গা পুজোরও পাঁচটি শরিকের জন্ম হয়। বাৎসরিক পালা করে প্রতি শরিক বংশ পরম্পরায় পুরনো রীতিনীতি মেনে আজও পুজো করে চলেছে। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

জনদর্পণ ডেস্ক : বঙ্গে এক সময়ে জমিদারদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল দুর্গা পুজো। পরে ধীরে ধীরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও সেই পুজো আজও চলমান। বরং জনপ্রিয়তার নিরিখে এই দুর্গা পুজো এখন বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে পরিণত হয়েছে।
প্রথম দিকে জমিদাররা দুর্গা পুজোর সূচনা ঘটালেও ক্রমশ তাদের হাত থেকে এই পুজো চলে আসে সর্বসাধারণের হাতে। প্রথমে বারোয়ারী, তারপর সার্বজনীনে রূপ পায়। তবে কিছু জমিদার পরিবারের সদস্য আজও পুরনো ঐতিহ্য মেনে তাদের পূর্বপুরুষের শুরু করা দুর্গা পুজোর ভার নিজেদের হাতে রেখে দিয়েছেন। এই সমস্ত পুজোকে এখন আর জমিদার বংশের পুজো না বললেও চলে। বরং বারোয়ারী পুজো বলায় ভালো।
এই রকমই একটি প্রাচীন দুর্গা পুজো আজও পুরনো রীতিনীতি বা ঐতিহ্য মেনে পরিচালনা করে চলেছে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট ২ নং ব্লকের শিকাড়া কুলীন গ্রামের ঘোষ পরিবার। এই পরিবারেই এক সময় জন্মগ্রহণ করে ছিলেন স্বামী বহ্মানন্দ মহারাজ বা রাখাল চন্দ্র ঘোষ। যিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মানসপুত্র তথা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ দেবের সংস্পর্শে আসারও মাস দুয়েক আগে তিনি রামকৃষ্ণ দেবের সংস্পর্শে আসেন।
ঘোষ পরিবারের এই দুর্গা পুজো এবছর ৩২১ বছরে পদার্পণ করল। প্রাচীনত্ব তথা ঐতিহ্যের নিরিখে এই পুজো সব সময়েই ব্যতিক্রমী। এই পুজোর পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে ঘোষ পরিবারের বর্তমান সদস্য নিলাদ্রী ঘোষ জানালেন, ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সদানন্দ ঘোষ হুগলি জেলার আকনা থেকে এসে এই শিকাড়া কুলীন গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পার্শ্ববর্তী ট্যাটরার চৌধুরী বাড়ির জামাতা হিসাবে বিবাহের যৌতুক স্বরূপ একটি জমিদারি লাভ করেই তিনি এখানে এসেছিলেন। তার অনেক পরে সদানন্দ বাবুর বংশধর দেবীদাস ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এই দুর্গা পুজোর সূচনা করেন। প্রথমে এই পুজো শুরু হয়েছিল গোলপাতার ছাউনি দেওয়া মাটির আটচালা ঘরে। ১৮১০-২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জমিদার কালীপ্রসাদ ঘোষ পাঁচ খিলানযুক্ত দু’মহলা দুর্গা দালান নির্মাণ করেন। যে মন্দিরে আজও দুর্গা পুজো হয়ে চলেছে।

জমিদার কালীপ্রসাদ ঘোষের পাঁচ সন্তান ছিল, যথাক্রমে শম্ভুচন্দ্র, হরিশচন্দ্র, উমেশচন্দ্র, মধুসূদন ও গোবিন্দচন্দ্র। পরে এই পাঁচ সন্তানের মধ্যে জমিদারি ভাগ হয়ে যায়। এবং সেই সঙ্গে দুর্গা পুজোরও পাঁচটি শরিকের জন্ম হয়। বাৎসরিক পালা করে প্রতি শরিক বংশ পরম্পরায় পুরনো রীতিনীতি মেনে আজও পুজো করে চলেছে।
কথিত রয়েছে, ১৮২০ সাল নাগাদ জমিদার কালীপ্রসাদ ঘোষ বাড়ির ভিত খননের সময় একটি ‘ঘট’ খুঁজে পান। তিনি স্বপ্নে এই ঘটের মধ্যে মা করুণাময়ী-কে বিরাজ করতে দেখেন এবং তাকে নিত্য পুজো করার আদেশ পান। পরে সেই ঘট তিনি বোধন বৃক্ষ সংলগ্ন স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিত্যপুজো শুরু করেন। যে পুজো আজও করে চলেছে তাঁর বর্তমান বংশধরেরা।
প্রতি বছর জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজোর মাধ্যমে এই পুজোর শুভ সূচনা হয়। প্রতিপদের দিন ঘট স্থাপন করা হয় শ্রীধর নারয়ণ মন্দিরে। যেখানে পঞ্চমী পর্যন্ত চন্ডীপাঠ চলে। ষষ্ঠীর দিন বোধন বৃক্ষের নীচে হয় বোধন অনুষ্ঠান (এক সময়ে এই বোধন বৃক্ষের নিচে স্বামী বহ্মানন্দ মহারাজ ধ্যান করতেন)। সপ্তমীর দিন প্রতিপদে প্রতিষ্ঠা করা সেই ঘট দুর্গা দালানে তুলে এনে আরম্ভ হয় সপ্তমীর পুজো। অষ্টমীতে সন্ধিপুজো ও বংশের প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়। নবমীর দিন করুণাময়ী মাকে দুর্গা দালানে তুলে আনা হয়। সেদিন একই সঙ্গে দুর্গা, করুণাময়ী মা ও শ্রীধর নারায়ণের পুজো হয়। এদিন আবার মহানৈবদ্যেরও আয়োজন করা হয়ে থাকে। পূর্বে এই পুজোয় বলিদানের প্রথা থাকলেও ১৯৪০ সাল থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়।