পালকি ছিল মূলত রাজ ঘরানা বা অভিজাত সম্প্রদায়ের বাহন। পরে ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমে যায়। কালের বিবর্তনে এখন পালকির ব্যবহার শুধুই নামমাত্র। অপরদিকে ‘ঘোড়া নাচ’ রাঢ় বাংলার লোকায়ত জীবন দর্শনের অন্যতম নিদর্শন। পূর্বে অগ্রহায়ণের শেষে ফসল কাটার পর কৃষিজীবী মানুষেরা তাঁদের আনন্দানুষ্ঠান করতেন এই ঘোড়া নাচের মাধ্যমে। পালকি আর ঘোড়া নাচ, এই লুপ্তপ্রায় দুই শিল্পের উপকরণ তৈরি নিয়ে বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করেছে সৃজনী। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

জনদর্পণ প্রতিনিধি : বাংলার গ্রাম্যজীবনের বহু প্রাচীন লোকায়ত সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ধারক হিসাবে পালকি অন্যতম। সংস্কৃত শব্দ ‘পল্যঙ্ক’ বা ‘পর্যঙ্ক’ থেকেই পালকির প্রকাশ। মূলত সেগুন বা শাল কাঠ দিয়ে পালকি তৈরি করা হত।
প্রথম দিকে রাজ ঘরানা বা অভিজাত সম্প্রদায়ের বাহন পদ্ধতির মূল উপাদান ছিল এই পালকি। তার কাঠামো এবং রূপ ছিল দৃষ্টি আকর্ষণকারী। যারা পালকি বহন করত তাদের বলা হত ‘বেহারা’। মূলত কাহার সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরাই পালকি বহনে যুক্ত থাকত। আর তাদের মাধ্যমেই শুরু হয় পালকির গান, ছন্দে ছন্দে ‘হুন-হুনা’ ধ্বনি সম্বলিত সেই গানে উজ্জীবিত হতেন তারা। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পালকির ব্যবহার কমেছে ধীরে ধীরে। পরবর্তীতে শুধুমাত্র বিবাহ উৎসবেই নববধূর প্রথম বার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার দেখা গিয়েছে।
কালের বিবর্তনে পালকির ব্যবহার এখন নামমাত্র। সুপ্রাচীন লোকসংস্কৃতির এই উপাদান মানব জীবনে হয় কল্পনায় অথবা চলচিত্রের পর্দায়। সেই প্রাচীন ঐতিহ্যকেই আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র (সংস্কৃতি মন্ত্রক, ভারত সরকার) আয়োজন করেছে ‘পালকি তৈরির কর্মশালা’। শান্তিনিকেতনের সৃজনী শিল্পগ্রামে গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে এই ১৫ দিনের বিশেষ কর্মশালা। অংশগ্রহণ করছেন বীরভূম জেলার লাভপুর থেকে আগত লোকশিল্পীরা। কর্মশালা চলবে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
লাভপুর থেকে আসা কাষ্ঠশিল্পী রাধামাধব ঘোষ জানালেন, গ্রামবাংলায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া পালকি শিল্প এইরকম বিশেষ কর্মশালার আয়োজনে তাঁরা দারুণ উৎসাহ পেয়েছেন।

অন্যদিকে সৃজনী শিল্পগ্রামে ‘ঘোড়ানাচ’-এর অন্যতম উপাদান ঘোড়া তৈরির কর্মশালা শুরু হয়েছে। রাঢ় বাংলার লোকায়ত জীবন দর্শনের অন্যতম নিদর্শন এই ‘ঘোড়া নাচ’। পূর্বে অগ্রহায়ণের শেষে ফসল তোলার পর কৃষিজীবি মানুষেরা তাদের এই প্রমোদ নৃত্যের মাধ্যমে আনন্দানুষ্ঠানে মেতে উঠতেন। মূলত ঘোড়ার মুখ সহ বাঁশের কাঠামো পরিধান করে এবং ঘোড়ার সাজ-সজ্জা ধারণ করে তারা ঘোড়ার মতো বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে এই নাচ করতেন। ঘোড়া নাচের ক্ষেত্রে নৃত্যশিল্পীর পায়ের নাচ দেখে বাকি দুটি পায়ের অস্তিত্ব কল্পনা করে নিতে হয়।
ঘোড়া নাচের উপকরণ তৈরির এই কর্মশালাও ১৫ দিনের জন্য আয়োজন করা হয়েছে। এই আয়োজন শুরু হয়েছে গত ১৬ সেপ্টেম্বর এবং শেষ হবে ৩০ সেপ্টেম্বর। ঘোড়া নাচের ঘোড়া তৈরিতে অংশগ্রহণ করেছে লাভপুরের ধনডাঙার দুই ঘোড়া নাচ শিল্পী বাচ্চু দাস ও মাধব দাস। সৃজনী শিল্পগ্রামের আধিকারিক অমিত অধিকারী জানালেন, “গ্রাম-বাংলার এই লুপ্তপ্রায় শিল্পকর্ম পুনরুজ্জীবন ঘটাতে ও জনসমক্ষে তুলে ধরতে আমাদের এই কর্মশালার মূল লক্ষ্য।”