নাটক, লোকনাট্য ও যাত্রার মঞ্চে দাঁড়িয়ে খুব সহজেই কন্যাভ্রূণ হত্যা, বাল্য বিবাহ, পণ প্রথা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, জাতপাতের বেড়াজাল, ধর্মের গোঁড়ামি, কুসংস্কারের মতো অসামাজিক ক্রিয়া-কর্মের বিরুদ্ধে জোর গলায় প্রচার করা যায়। আর এই কাজটিই করে চলেছে বীরভূমের একদল অভিনেত্রী। এঁরা প্রত্যেকেই অতি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলা। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের জন্য এঁদের হাতে একেবারেই কোনও কাজ নেই। তাই সংসারে নেমে এসেছে চরম দরিদ্রতা। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |
জয়দেব দেবাংশী : শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব একবার বলেছিলেন, অভিনয়ের মাধ্যমে লোকশিক্ষা হয়। কথাটি একেবারেই ঠিক। যে কোনও বিষয়ের বক্তব্যকে সকল স্তরের মানুষের কাছে অতি সহজে ও সরাসরি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব একমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমে। নাটক, লোকনাট্য ও যাত্রার মঞ্চে দাঁড়িয়ে খুব সহজেই কন্যাভ্রূণ হত্যা, বাল্য বিবাহ, পণ প্রথা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, জাতপাতের বেড়াজাল, ধর্মের গোঁড়ামি, কুসংস্কারের মতো অসামাজিক ক্রিয়া-কর্মের বিরুদ্ধে জোর গলায় প্রচার করা যায়। কম সময়ের মধ্যে এই সব ঘটনাগুলিকে নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষের গোচরে এনে তার বিবেক বোধকে জাগ্রত করা যায় সহজে।
এই বীরভূম জেলারই নাটক, লোকনাট্য বা যাত্রাপালার অনেক কলাকুশলী এই সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত রয়েছেন। জেলায় এদেরই বেশ কিছু অভিনেত্রী অতি সুনামের সঙ্গে অভিনয় করে আসছেন। এঁরা প্রত্যেকেই অতি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলা। সংসারের দরিদ্রতা মোচন আর অভিনয়কে ভালোবেসেই তাঁদের এই পেশায় প্রবেশ।
বর্তমানের করোনা মহামারির জন্য প্রায় এপ্রিল মাস থেকেই কোনও অনুষ্ঠানের ডাক আসেনি তাঁদের কাছে। এতদিনের সম্বল হিসাবে যা ছিল সঞ্চয়, কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছে তা সবই। সামনেই দুর্গোৎসব। তা শেষ হতে না হতেই কালী পুজো বা দীপাবলি। তার পিছনে পিছনেই রাস আর নবান্ন। অন্যান্য বার এই সমস্ত অনুষ্ঠানগুলিতেই মঞ্চাভিনয়ের জন্য ‘বায়না’ চলে আসে এতদিনে। কিন্তু এবছরটি যেন এক্কেবারেই ‘কুপয়া’। কোনও বায়না আসেনি এখনও। করোনা সংক্রমণের কারণে অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে বায়না না আসার সম্ভাবনায় এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি।
সিউড়ির কুমকুম বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌসুমি সিংহ, জ্যোৎস্না সরখেল, সোনালী মণ্ডল, কুড়মিঠা গ্রামের মিনা মণ্ডল, লাভপুরের জবা ভট্টাচার্য, কৃষ্ণা মুখোপাধ্যায়, নারায়ণী গোস্বামী সাঁইথিয়ার চন্দনা দাস, পিংকি ধারা, মৌমিতা বিশ্বাস সহ আরও অনেক অভিনেত্রী ছড়িয়ে রয়েছেন বীরভূমের আনাচে কানাচে। তাঁদের সবারই এখন প্রায় একই অবস্থা। চরম দরিদ্রতার মধ্য দিয়েই জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে তাঁদের।
অভিনেত্রী মৌসুমি বিশ্বাস ও জ্যোৎস্না সরখেল জানালেন, গত বছর ডিসেম্বর মাসের ১৯ তারিখ জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরে একটি দরখাস্ত দিয়েছিলেন বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলিকে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রচার কার্যে যুক্ত করতে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোনও উত্তর পাননি তাঁরা।
এঁদের অনেকেরই এখনও স্বাস্থ্য বিমার কার্ড হয়নি। তাই লাভপুরের দুজন প্রবীণ অভিনেত্রীর চোখে ছানি পরলেও, তাঁরা অর্থের অভাবে অপারেশন করাতে পারছেন না।
জীবন যেন আর কিছুতেই এগোতে চাই না এঁদের। ভাঁড়ারে চাল নেই, আঁচলে গোজা টাকাও নেই। সংসার টিকিয়ে রাখতে দুবেলা সাহায্যের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন অন্যের দুয়ারে, যদি কোথাও এতটুকু সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু সাহায্য মিলছে কোথায়?