১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমোদপুরে ফিরে আসেন রজতভূষণ দত্ত। আসার দু’বছর পর দেশ স্বাধীন হল। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন হলেও এতদিন ধরে শৃঙ্খল পড়ে থাকার যন্ত্রণার রূপ প্রকাশ পেতে নানারকম সমস্যার সমষ্ঠির মাধ্যমে। আন্দামান ফেরত রজতভূষণ আমোদপুর অঞ্চলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সমস্যাগুলি ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারলেন। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |
সুজয় ঘোষাল : বীরভূম জেলার অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রজতভূষণ দত্তের নাম স্মরণীয়। তাঁর বিপ্লবী কর্মকান্ডের পরিধি তাঁকে বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলার মূল আসামী আখ্যা দিয়েছে। দেশহিতের জন্য সুদীর্ঘ ১২ বৎসর তাকে কাটাতে হয়েছে আন্দামানের সেলুলার জেলে। কিন্তু শুধুমাত্র বিপ্লববাদের পরিধির মধ্যে তাঁকে বিচার করলে সমাজ সংগঠন তথা পল্লী চর্চার অপরসীম গুরুত্বকে সীমায়িত করা হয়। এর সাথে অন্তরালে ঢাকা পড়ে যায়, আমোদপুরের সমাজ উন্নয়ণে তাঁর পরিশ্রমী, সংযমী, দৃঢ়চেতা মনোভাবের প্রকাশ ও সেগুলির সঠিক রূপায়ণ। রজতভূষণ দত্তকে আমোদপুর শহরের রূপকার বললে অত্যুক্তি হবে না। কেনও না তাঁর ভাবনার আর্দশে আমোদপুর শহরে স্ত্রী শিক্ষা থেকে শুরু করে জনশিক্ষার প্রসার ঘটেছে।
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমোদপুরে ফিরে আসেন রজতভূষণ দত্ত। আসার দু’বছর পর দেশ স্বাধীন হল। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন হলেও এতদিন ধরে শৃঙ্খল পড়ে থাকার যন্ত্রণার রূপ প্রকাশ পেতে নানারকম সমস্যার সমষ্ঠির মাধ্যমে। আন্দামান ফেরত রজতভূষণ আমোদপুর অঞ্চলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সমস্যাগুলি ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারলেন। এই সময় আমোদপুরে নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও অশিক্ষার ব্যাধিতে ভুগেছিল। দরিদ্রতার ও অর্থ অনটনের জ্বালায় জ্বলছিল উদ্বাস্তু থেকে শুরু করে দরিদ্র কৃষকেরা।
রজতভূষণ বুঝতে পারলেন কোনও কিছুর উন্নয়ণ করতে হলে সার্বিকভাবে শিক্ষা নামক মূল কাঠামোর ভিতকে মজবুত করতে হবে। সেই সময় আমোদপুর অঞ্চলে নারীশিক্ষা ও লোকশিক্ষার প্রসারকে অন্ধকার থেকে টেনে তুলতে চাইলেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল কোনও না কোনও উপায়ে নিরক্ষতাকে নিমূল করা। তাই একের পর এক প্রতিষ্ঠা করে চললেন আমোদপুর জয়দূর্গা গ্রন্থাগার, জয়দূর্গা বালিকা বিদ্যালয়, রামকৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়।
আমোদপুর অঞ্চলে গণশিক্ষার ব্যাপ্তি যাতে দ্রুত হয় সেই উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালে নিজের জমিতেই স্থাপন করলেন একটি গ্রন্থাগার। শুধু স্থাপন-ই করলেন না, নিজের জমিতে গ্রন্থাগারের নামে একটি দ্বিতল ভবনও নির্মাণ করে দিলেন। নীচের তলায় বই থাকবে আর দ্বিতলে পাঠকরা বই পড়বেন। গণশিক্ষার প্রসারের জন্যই আমোদপুরের নীহারিকা ক্লাব পরিণত হল আমোদপুর জয়দুর্গা গ্রন্থাগার নামে। তিনি জানতেন গ্রন্থাগার থাকলে জনশিক্ষার প্রসার ধীরে ধীরে অগ্রসর হবে। জ্ঞানের জানালা উন্মুক্ত হবে পাঠকের কাছে। তখন এই গ্রন্থাগার সরকার পোষিত ছিল না। তাই নিজের প্রচেষ্টায় বই সংগ্রহ করতে থাকেন। নিজের সংগ্রহে থাকা বেশ কিছু বই তিনি এই গ্রন্থাগারে দানও করলেন। প্রথমে বই বসে পড়ার জন্য চেয়ার টেবিল, বই রাখার আলমারি ইত্যাদি ছিল না। তাই বেশকিছু আসবাবপত্রও দিলেন লাইব্রেরীকে। আজও, তার দান করা চেয়ার, কাঠের গোলাকার টেবিল জয়দূর্গা গ্রন্থাগারে দেখতে পাওয়া যায়।
গ্রন্থাগারের পাশাপাশি তিনি নারীশিক্ষার প্রগতির জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের কথা ভাবলেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে নারীদের মধ্যে স্বাক্ষরতার অভাবের ফলে স্ত্রী শিক্ষার দিক অনেক পিছিয়ে ছিল এই অঞ্চলে। ১৯৫৩ সালে রজতভূষণ নিজের বসত বাড়ির নীচের ঘরে সামান্য জায়গায় জয়দুর্গা বালিকা বিদ্যালয়ের স্থাপন করলেন। প্রথমে পাঁচজন ছাত্রী নিয়েই শুরু হয় স্কুল। এই পাঁচজন ছাত্রীর মধ্যে একজন ছিলেন রজতভূষণের ভ্রাতুস্পুত্রী। গ্রন্থাগার স্থাপনের মতোই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেই থেমে থাকেননি তিনি। সকালের আহার সেরেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন আমোদপুরের পাশ্ববর্তী গ্রামগুলিতে ছাত্রী সংগ্রহের জন্য। মেয়েদের অভিভাবকদের রজতভূষণ বোঝাতেন স্বাধীন ভারতবর্ষে নারীশিক্ষার গুরুত্বের কথা। কর্মীর অভাবে সেসময় রজতভূষণ নিজেই শিক্ষকতার কাজ, ঘন্টা পেটানোর কাজ ও কেরানির কাজ করেছেন। ধীরে ধীরে বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকল। পরে আমোদরপুর-সিউড়ি সড়কে এই স্কুল সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি নিজের জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ বিদ্যালয়। শুধু এই নয় তিনি প্রথমিক শিক্ষার প্রসারের জন্য একটি প্রাইমারী স্কুলও স্থাপনের জন্য জমিদান করেন। তাঁর মুত্যুর পর স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রাইমারী স্কুলটির নাম রজতভূষণের স্মৃতির নামে উৎসর্গ করেন।