লুপ্তপ্রায় মাছ বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে গ্রাম-বাংলার মানুষদেরকেই

Advertisement
বছর ২০ আগেও গ্রাম-বাংলার খাল-বিলে দেখা মিলত খলশে, পুঁটি, টেংরা, মৌরলা, কই প্রভৃতি দেশি মাছগুলিকে। এখন বর্ষাকাল ছাড়া এদের তেমনভাবে প্রায় দেখতেই পাওয়া যায় না। তাই এই লুপ্তপ্রায় মাছগুলিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে বর্ষাকালেই। শুধুমাত্র সরকারি প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর না করে, এই সংরক্ষণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে গ্রাম-বাংলার মানুষদেরকেই। – ছবি : সংগৃহীত

people of rural bengal have to take the initiative to save the endangered fish

সোমনাথ মুখোপাধ্যায় :কথায় বলে, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। মাছ নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতার অন্ত নেই। সাহিত্যে সেই চর্যাপদের যুগ থেকে বাঙালির মৎস্য প্রীতির সুগভীর পরিচয় পাওয়া যায়। পাল যুগের বিভিন্ন টেরাকোটা শিল্পে মাছের সুন্দর সুন্দর মোটিফ পাওয়া গেছে। চর্যাপদে আছে সেই মোহিনী মাছের কথা। বর্তমানে যাকে আমরা মৌরলা মাছ বলে থাকি। সেই মাছের টক যে হাজার বছর আগেও বাঙালির ঘরে ঘরে জনপ্রিয় ছিল, তাতে আর সন্দেহ কী!
     কিন্তু হায়! রকমারি মাছের সেই রমরমার যুগ আর নেই। মাছের দাম এই বর্ষাকালেও আকাশ ছোঁয়া। কাজেই ‘মৎস্য ধরিব খাইব সুখে’ এমনটা আর বলা যাচ্ছে না। অথচ বছর কুড়ি আগে পর্যন্ত খাল-বিলে যেসব খলশে, পুঁটি, টেংরা, মৌরলা, দাঁড়কে, কই, মাগুর, সিঙ্গী, চ্যাং, চিঙুড়ি মাছ বাঙালির রসনাকে পরিতৃপ্ত করত, তাদের দিন গিয়াছে। আমরা নানাভাবে পরিবেশের দূষণ ঘটিয়ে যেভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করেছি তাতে এইসব দেশি বৈচিত্র্যময় মাছ এখন লুপ্তপ্রায়। সরকারিভাবে অবশ্য এইসব মাছেদের পুনরায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কিন্তু শুধু সরকারি প্রচেষ্টাতেই এইসব মাছকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এর জন্য গ্রাম-বাংলার মানুষকেও উদ্যোগ নিতে হবে।
     সারাবছর অমিল হলেও বর্ষাকালে গ্রামবাংলায় এখনও এদের দেখা মিলছে। এবারে বর্ষার পরিমাণ ঠিকঠাক থাকায় বাজারে প্রায়শই এইসব সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর মাছেদের যোগান কিছুটা হলেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এইসব মাছকে আরও বাড়ার সুযোগ দিতে হবে। পেস্টিসাইডের ব্যবহার কমাতে হবে। অযথা এই মাছকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ধরা চলবে না। ছোট পুকুর, খাল-বিল, জলাশয় বা নয়ানজুলিতে এইসব মাছকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে। এদের জন্য জলাশয়গুলি বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা দরকার। এইসব জলাশয়ে কোনও ক্রমেই বড় মাছ চাষ করা চলবে না। সেই সঙ্গে জলাশয়গুলি সংস্কার করতে হবে, যাতে সেগুলিতে সারাবছর জল থাকে। এইসব বিরল প্রজাতির ছোট মাছের বৈজ্ঞানিক প্রজননের জন্য মৎস্য দপ্তরকে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। আর সব কিছু করার জন্য সবচেয়ে ঠিকঠাক সময় হল এই বর্ষাকাল।
people of rural bengal have to take the initiative to save the endangered fish 2
     আমাদের স্মরণ করা দরকার, এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবী শ্রদ্ধেয় পান্নালাল দাশগুপ্ত মশাই বর্ষাকালে ‘মীন মঙ্গল’ উৎসব শুরু করেন। তার উদ্যোগে প্রতিবছর শান্তিনিকেতনে শ্যামবাটির খালে মাছের ডিম পোনা ছাড়া হতো। এরকম একটি উদ্যোগে একবার শামিল হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এরকম উদ্যোগ গ্রাম-বাংলায় স্থানীয়ভাবে আরও বেশি করে নিতে হবে।
     প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ২ আগস্ট বীরভূম জেলার তিলপাড়া ব্যারেজে একটি বিচিত্র বৃহৎ মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ে। তিলপাড়া ব্যারেজে সারা বছরই স্থানীয় মানুষ টুকটাক মৎস্য শিকার করে থাকেন। কিন্তু বর্ষাকালে জেলেদের মাছ ধরার উদ্যোগটা একটু বেশি রকমই চোখে পড়ে। এর কারণ ব্যারেজের গভীর জলে রাঘব বোয়ালদের সন্ধান এইসময়ে একটু বেশি মাত্রায় পাওয়া যায়।
     এদিন জেলেদের জালে যে মাছটি ধরা পড়েছিল সেটি একটি বৃহৎ বাঘা আড় মাছ। মাছটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি যথেষ্ট পরিণত বয়স্ক। এই ধরনের মাছ গঙ্গায় প্রায়শই দেখা যায়। তবে ময়ুরাক্ষীর মতো নদীতে এর দেখা পাওয়া বেশ অবাক করার মতোই ঘটনা। এই ধরণের বিরল মাছেদের ছেড়ে দেওয়াই এইসব মাছ সংরক্ষণের প্রকৃষ্ট উপায়। বর্ষাকালে অনেক মাছই হাতের কাছে উঠে আসে, লোভ সংবরণ করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হলে ভবিষ্যতে আরও এই ধরনের মাছের যোগান বৃদ্ধি পাবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু রসনাকে রোখা বড় দায়। তাই দিন দিন বাঙালির রসনা তৃপ্তকারি এইসব মাছের যোগান কমছে আমাদের লোভের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এই বর্ষাকালে মাছ সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতন না হতে পারলে ভবিষ্যতে আমাদের রসনাকে অনেক মূল্য চোকাতে হবে তাতে সন্দেহ নেই।
Advertisement
Previous articleনতুন শিক্ষা নীতিতে ঘাটতি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে
Next articleরবীন্দ্রনাথের কাছে ‘রাখীবন্ধন’ ছিল প্রীতির বন্ধন, মানব বন্ধন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here