Advertisement
নক্ষত্রদের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় তাদের মৃত্যু প্রসঙ্গে। মৃত্যুর পর নক্ষত্রদের অবস্থা কি হতে পারে, তা নিয়ে চলেছে একের পর এক গবেষণা। সে গবেষণার সূত্র ধরে জানা গিয়েছে, মৃত্যুর পর নক্ষত্রেরা সাধারণত ৪টি অবস্থায় আসতে পারে। তবে তার পুরোটাই নির্ভর করে তাদের ভরের ওপর। – ছবি : সংগৃহীত
|
সজয় পাল : জন্মের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে মৃত্যু। অর্থাৎ জন্ম নিলে তাকে অবশ্যই মরতে হবে। চির এই সত্যকে যুগ যুগ ধরে মেনে এসেছে সবাই। যদিও জন্ম-মৃত্যুর কঠিনতম এই রহস্য এখনও আলো-ছায়ার অন্তরালে রয়ে গিয়েছে। তার প্রকৃত সত্য উন্মোচন করা আজও পুরোপুরি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মৃত্যুর পর তার সমস্ত সত্ত্বা একটা নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয়। অবশ্য বিজ্ঞানের কাছে মৃত্যু মানেই সব শেষ নয়। তার পরেও কিছু অবশিষ্ট থাকে। এক্ষেত্রে মৃত্যু হল তার অবস্থা পরিবর্তনের একটা উপায় মাত্র।
এই যেমন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, কোটি কোটি বছর আগে বিশাল এক ‘বিগ ব্যাঙ’-এর ফলে সৃষ্টি হওয়া অপার বিস্ময়। সৃষ্টির প্রাথমিক পর্বে সে ছিল খুবই ছোটো। ধীরে ধীরে তার আকার বেড়েছে। এবং ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কোনও একদিন সে হয়তো তার পরিধির শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে। তারপর আবার শুরু হবে তার ছোটো হওয়া। অর্থাৎ সে তখন ধীরে ধীরে মৃত্যু বা তার রূপ পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু সে তো আর দু-এক দিনের ব্যাপার নয়। কোটি কোটি বছর বা তারও বেশি ব্যবধানের ব্যাপার।
রাতের আকাশে চোখ রাখলে অসংখ্য জ্যোতিষ্কের মধ্যে যাদের সবচেয়ে বেশি দেখা, তাদের বেশিরভাগই হল এই নক্ষত্র। ব্রহ্মাণ্ডে মোট কতগুলি নক্ষত্র আছে, তার সঠিক সংখ্যা কেউ হয়তো কোনও দিনও ঠিকঠাক বলতে পারবে না। বিশেষজ্ঞদের দাবি, কোনও এক বর্ষাকালে কলকাতার বুকে টানা সাতদিন যদি মুষলধারে বৃষ্টি হয়। তার যতগুলি ফোঁটা মাটিতে পড়বে, বিশাল এই ব্রহ্মাণ্ডে হয়তো তার থেকেও অধিক নক্ষত্র রয়েছে।
জন্ম যখন হয়েছে, নক্ষত্রদের মৃত্যুও তো অবধারিত। নক্ষত্রদের মৃত্যু বলতে এখানে বলা হবে তাদের ভেতরের জ্বালানী শেষ হয়ে যাওয়া। প্রত্যেকটা নক্ষত্রই হাইড্রোজেন জ্বালানীর মাধ্যমে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু যখন জ্বালানী শেষ হয়ে যায়, তারা আর নিজেদের আগের অবস্থা ধরে রাখতে পারে না। রূপ বদলে ফেলে। ঠিক যেমন মানুষের বৃদ্ধ অবস্থা।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, মৃত্যুর পর নক্ষত্রদের যে কোনও চারটি অবস্থা হতে পারে। (১) কিছু নক্ষত্র আছে যারা মৃত্যুর সময় সুপারনোভা হয়ে নিজেদের ফাটিয়ে ফেলে। এবং শরীরের কোনও অবশিষ্টাংশই আর বাকি থাকে না। অর্থাৎ সারা জীবনের জন্য মহাকাশে নিজেদের বিলীন করে দেয়। (২) সাদা বামন তারা-ই পরিণত হয়। (৩) পালসার বা নিউট্রন তারা-ই পরিণত হয়। (৪) ব্লাকহোল বা কৃষ্ণ-গহ্বর সৃষ্টি করে।
![]() |
ব্ল্যাকহোল |
যে কোনও নক্ষত্রের শেষ পরিণতি তার ভরের অপর নির্ভর করে। কোনও নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের ১.৪ গুন বা চন্দ্রশেখর ভরের মধ্যে থাকে তবে সে সব নক্ষত্র মৃত্যুর পর ‘সাদা তারা’ হয়ে তাদের বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়। জ্বালানী ফুরিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে এই নক্ষত্রেরা আয়তনে কিছুটা বেড়ে যায় এবং লাল হয়ে জ্বলতে থাকে। তারপর যখন আরও জ্বালানী ফুরিয়ে আসে তখন অত্যধিক মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। এবং অবশেষে ‘সাদা বামন তারা’-ই পরিণত হয়। এই অবস্থায় তার গড় ঘনত্ব অত্যধিক বেড়ে যায়। একটি ‘সাদা বামন তারা’-ই মাধ্যাকর্ষণ বস্তুকে এতখানি সঙ্কুচিত করে যে গড় ঘনত্ব জলের ঘনত্বের প্রায় ১০০ কোটি গুণ হয়ে যায়। কিন্তু সে আকৃতিতে যথেষ্ট ছোটো হয়ে যায়। যদি কোনও ‘সাদা বামন তারা’-র ভর সূর্যের ভরের সমান ধরা হয়, তবে তার আকার হয়ে যাবে প্রায় পৃথিবীর সমান। লুব্ধক নক্ষত্রটির পাশে এরকমই একটি ‘সাদা বামন তারা’ রয়েছে। যেটি জ্যোতিষ বিজ্ঞানীদের প্রথম আবিস্কৃত ‘সাদা বামন তারা’।
আবার কোনও নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভর অপেক্ষা ১.৪ গুণ থেকে ৩ গুনের মধ্যে থাকে, তাহলে মৃত্যুর পর সেই সব নক্ষত্রেরা নিউট্রন তারা বা ‘পালসার’-এ রূপান্তরিত হয়। এটি অত্যন্ত ছোটো এবং অত্যন্ত ঘন একটি জ্যোতিষ্ক। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী মজা করে একে মহাকাশের ‘লাইট হাউজ’-ও বলে থাকেন। কারণ পালসার নির্দিষ্ট সময় অন্তর হ্রস বেতার তরঙ্গের ঝলক নিঃসৃত করে। তখন নির্দিষ্ট সময় অন্তর এদেরকে অদৃশ্য হতে ও জ্বলে উঠতে দেখা যায়। এরা যে ঝলক নিঃসৃত করে তার কাল-পরিমাণ ০.০০৩ সেকেন্ড থেকে ০.১৬ সেকেন্ড। প্রথম ‘পালসার’ আবিস্কৃত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে।
এবার আসা যাক ‘ব্লাকহোল’ বা কৃষ্ণ-গহ্বর প্রসঙ্গে। যাকে নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের শেষ নেই। কোনও নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের ৩ গুণ অপেক্ষা বেশি হয়, তবে সে সব নক্ষত্র জীবনের শেষ অবস্থায় পৌঁছে ‘সুপার নোভা’ হয়ে বিস্ফোরিত হয়। এ অবস্থায় ওই নক্ষত্রের কেন্দ্রের ভর এত বেশি হয় যে তার মাধ্যাকর্ষণ বলের বিরোধী কোনও বহির্মুখী বল বা চাপ তার প্রতিরোধ করতে পারে না। তারপর ধীরে ধীরে ওই নক্ষত্রটির কেন্দ্রাঞ্চল কৃষ্ণ-গহ্বরে পরিণত হয়।
কৃষ্ণ গহ্বরের ঘনত্ব হয় অতি বিশাল। যাকে কল্পনার বাইরে রাখায় ভালো। এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এতটাই শক্তিশালী হয় যে সব কিছুকেই, এমনকি আলোক রশ্মি বা বেতার তরঙ্গকেও গ্রাস করে ফেলতে পারে। একবার ভেতরে পড়লে কোনও কিছুই এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। কৃষ্ণ গহ্বরের ব্যাস সাধারণত তার ভরের উপর নির্ভর করে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ অনুসারে, যদি কোনও কৃষ্ণ গহ্বরের ভর সূর্যের ভরের ৬ গুণ হয় তাহলে তার ব্যাস হবে প্রায় ২২ মাইল। সম্প্রতি M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি কৃষ্ণ গহ্বর আবিস্কৃত হয়েছে। যার ভর কয়েকশো কোটি সূর্যের ভরের প্রায় সমান। অতএব তার ব্যাস যে অকল্পনীয়ভাবে বিশাল তা সহজেই বুঝতে পারা যায়।
আমাদের সৌরজগতের অধিপতি সূর্য কোনও দিন পালসার বা কৃষ্ণ-গহ্বরে পরিণত হবে না। কারণ তার ভর চন্দ্রশেখর সীমার মধ্যেই রয়েছে। মৃত্যুর পর সূর্য পরিণত হবে ‘সাদা বামন তারা’-ই। কিন্তু তার সেই রূপ দেখার সৌভাগ্য পৃথিবীবাসীর কখনওই হবে না। ‘সাদা বামন তারা’-ই পরিণত হওয়ার অনেক আগেই তার অকল্পনীয় মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে বৃহস্পতি পর্যন্ত সমস্ত গ্রহকে সে গ্রাস করে ফেলবে।
সূত্র :
মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় (নক্ষত্রের জন্ম মৃত্যু), প্রশান্ত প্রামাণিক
Advertisement