বর্ষার মরশুম এলেই বাঙালির মনে পড়ে যায় ইলিশের কথা। আর সেরার সেরা ইলিশ মানেই পদ্মার ইলিশ। পদ্মার ইলিশের তুলনা শুধু পদ্মার ইলিশকে দিয়েই করতে হয়। অন্য বছরের তুলনায় এবছর বাংলাদেশের মৎস্যজীবীদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে অনেক বেশি পরিমাণে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অন্যতম কারণ করোনা আবহ। করোনা আবহে লকডাউনের জন্য মৎস্যজীবীরা দীর্ঘদিন ইলিশ শিকারে বেরোতে পারেননি। – ছবি : সংগৃহীত |
সজয় পাল : বাঙালির কাছে মাছের রাজা নাকি ইলিশ! আর হবেই না কেন, স্বাদ আর গন্ধে অন্য মাছেদের থেকে এ যে একদমই আলাদা। এক খণ্ড পরিপুষ্ট দামি ইলিশ প্রতিবেশীর ‘কুনজর’ এড়িয়ে যদিবা নিয়ে আসা যায় বাড়িতে, কিন্তু রান্নার সময় ঠিকই টের পেয়ে যায় পাশের বাড়ির বউদি। আর সঙ্গে সঙ্গেই বউদি নিজের কর্তার কাছে বায়না করে বসেন, ওই রকম ইলিশ তারও এবার চাই। কর্তারও যে ইচ্ছা হয় না, তা নয়। কিন্তু দামের ভয়ে কৃপণ কর্তাটি একবার ‘না’ বলে দিলেই আর রক্ষা নেই। ‘লঙ্কাকাণ্ড’ চলতে থাকবে সারাদিন ধরে।
ইলিশ নিয়ে এরকম ঘটনা বাঙালির ঘরে ঘরে। বর্ষার মরশুম মানেই বাঙালির ঘরে হাজির হতেই হবে ‘বেচারা’ ইলিশকে। পালিয়ে বেড়ালে চলবে না। কিন্তু স্বাদের এই ‘রূপালী শস্য’ আদৌ বাঙালি? যদি গুছিয়ে বলতে হয়, গ্রাম-বাংলার পুকুর, খাল-বিলের আর পাঁচটা সাধারণ দেশি মাছের মতো নয়। তারা সারা বছরই ঘুরে বেড়ায় সমুদ্রের নোনা জলে। বর্ষার মরশুম অর্থাৎ ডিম পাড়ার মরশুমে তারা ‘উজান বেয়ে’ উঠে আসে সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত নদীগুলিতে। স্রোত যুক্ত নদীর কম নোনা জলে ডিম পেড়ে ‘মা ইলিশ’ আবার ফিরে যায় সমুদ্রগর্ভে। ডিম ফুটে ছোটো ছোটো ইলিশের ঝাঁকও পরে সেই সঙ্গে নদীর জলে ভেসে পৌঁছে যায় সমুদ্রে। তাই নদী হল ইলিশের জন্মস্থান, আর সমুদ্র তাদের বিচরণভূমি।
ইলিশের কথা উঠলে, প্রথমেই নাম চলে আসে পদ্মার ইলিশের। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, পদ্মার ইলিশের তুলনা শুধু পদ্মার ইলিশকে দিয়েই করতে হয়। আসলে মোহনার কাছে পদ্মার গভীরতা ও চওড়া অনেকটাই বেশি। বর্ষার মরশুমে পদ্মায় জলও থাকে প্রায় কানায় কানায়। হয়তো ইলিশ নিজেদের সুবিধার্থেই ডিম পাড়ার প্রথম পছন্দের জায়গা হিসাবে তাই পদ্মাকেই বেছে নিয়ে থাকে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী, হুগলী নদী বা দিঘার সমুদ্র অঞ্চলেও ইলিশের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু পদ্মার ইলিশের মতো অতো বড় আর স্বাদ-গন্ধের হয় কোথায়?
ইলিশ বাংলাদেশের প্রথম সারির একটি বাণিজ্যিক দ্রব্য। প্রতি বছর প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে সেদেশে মৎস্যজীবীদের জালে। কিন্তু অন্য বছরগুলির তুলনায় এবছর যেন একটু বেশিই ইলিশ ধরা পড়ছে। আর তাতেই বাংলাদেশের বাজারে ইলিশে ইলিশে ছয়লাপ হয়ে উঠেছে প্রায়। দামও অন্য বছরের তুলনায় অনেকটাই কম।
তবে কি কারণে অনেক বছর পর বাংলাদেশে এত ইলিশের আমদানি হল এবছর? বিবিসি সংবাদ মাধ্যমের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, এর জন্য দায়ী অনেকটা করোনা আবহ। এমনিতেই ইলিশ শিকারের ওপর বাংলাদেশ সরকারের কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। তাই সারা বছর সমানভাবে ইলিশ শিকার করতে পারেন না জেলেরা। এবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ছিল ইলিশ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবে দেশ জুড়ে লকডাউনের কারণে এই সময়সীমা আরও পূর্ব থেকে দীর্ঘ ছিল। এছাড়াও এবছর বর্ষা হয়েছে বেশ ভালোই। প্রাকৃতিক দুর্যোগও হয়েছে কয়েকটি। তাই নদীতে জলের পরিমাণ অন্য বছরগুলির তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। এই সুযোগে মা ইলিশ অবাধে বিচরণ করতে পেরেছে নদীগুলিতে। ২৩ জুলাইয়ের পর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় মৎস্যজীবীরা ইলিশ শিকারে বেরিয়ে অন্য বছরের তুলনায় বেশি ইলিশের সন্ধান পেয়েছেন।
বিবিসি সংবাদ মাধ্যমের ওই রিপোর্ট থেকে আরও জানা যাচ্ছে, ইলিশ বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু করোনা আবহ নয়, কয়েক বছরের বাংলাদেশ সরকারের বেশ কিছু সিদ্ধান্তও নদীতে ইলিশের পরিমাণ বাড়তে সাহায্য করেছে। মা ইলিশকে নিশ্চিন্তে ও অবাধে বিচরণ করার সুযোগ করে দিতে মৎস্যজীবীদের ইলিশ শিকারের ওপর সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে সেদেশের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়। এই বিধিনিষেধ অমান্য করলে কারাদণ্ড বা আর্থিক জরিমানাও হতে পারে। তাই এখন আর আগের মতো সারা বছর ধরেই ইলিশ শিকার করেন না মৎস্যজীবীরা। এ কারণেও ইলিশের পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়া স্বাভাবিক।