৯ আগস্ট নিজের বাড়ির বাথরুমে পড়ে গিয়ে গুরুতর আঘাত পান তিনি। তাঁকে ভর্তি করা হয় দিল্লির কনটেনমেন্ট সেনা হাসপাতালে। এক সময়ে গভীর কোমায় চলে যান তিনি। পরে ৩১ আগস্ট সকালে এক মেডিক্যাল বুলেটিনে জানানো হয়, তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। এই দিন বিকালেই সাড়ে ৫টা নাগাদ তাঁর পুত্র টুইট বার্তায় জানান, প্রণব মুখোপাধ্যায় পরলোক গমন করেছেন। – ছবি : সংগৃহীত |
বিজয় ঘোষাল : আরও এক নক্ষত্রের পতন ঘটল ৩১ আগস্ট। জীবনাবসান হল ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়-এর। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম কোনও বাঙালি রাষ্ট্রপতি। গত ৯ আগস্ট নিজের বাড়ির বাথরুমে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান তিনি। তাঁকে ভর্তি করা হয় দিল্লির কনটেনমেন্ট সেনা হাসপাতালে। এক সময়ে তিনি চলে যান গভীর কোমায়। ৩১ আগস্ট সকালেই হাসপাতালের মেডিক্যাল বুলেটিন জানিয়ে দেয়, তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। অবশেষে বিকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ তাঁর পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় টুইট বার্তায় জানান, প্রণব মুখোপাধ্যায় পরলোক গমন করেছেন।
বীরভূম জেলার কীর্নাহারের পাশ্ববর্তী কুয়ে নদী সংলগ্ন ছোট গ্রাম মিরাটী থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে উঠে আসা। এই উঠে আসার কাহিনী যে কোনও রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়ে দেবে। ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। বাবা কামদাকিংঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি বীরভূম জেলার অস্পৃশ্য সেবক সমিতিরও সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি উত্তরবঙ্গে কংগ্রেস লীগ গঠন করেন। তাই বাবার কারণে রাজনীতির সঙ্গে প্রণববাবুর বরাবরই সংযোগ ছিল।
গ্রাম থেকে প্রায় ২ মাইল দূরের কীর্নাহার শিবচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে প্রথম ব্যাচের পরীক্ষার্থী হিসাবে প্রণববাবু ম্যাটিক পাশ করেন। পরবর্তীকালে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডবল এম.এ অর্জন করেন তিনি।
এই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই সহপাঠী শুভ্রা দেবীর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই সেই আলাপ বিবাহ বন্ধনে পরিণত হয়। শুভ্রা দেবী ছিলেন একধারে অধ্যাপিকা, সংঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী ও সুলেখিকা।
প্রণববাবু জীবনের প্রথমদিকে ডাক বিভাগের কর্মী ছিলেন। পরে অধ্যাপনার সঙ্গেও কিছুদিন যুক্ত ছিলেন তিনি। অধ্যাপক থাকার সময়ে ‘দেশের ডাক’ সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার কাজও করেছেন।
রাজনৈতিক পরিসরে তাঁর উত্থান ছয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন বাংলা কংগ্রসের সদস্য হয়ে। বাংলা কংগ্রেসে থাকা সুশীল ধাড়া, সতীশচন্দ্র সামন্ত সহচর্যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে আর্শীবাদধন্য হয়ে ওঠে। সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ ঘটে ১৯৬৯ সালে রাজ্যসভা নির্বাচনে বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে। প্রণববাবু এই নির্বাচনে জিতে বাংলা কংগ্রেসের প্রথম ও শেষ সংসদ সদস্য হিসাবে ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করেন।
এরপর সুশীলবাবুর সঙ্গে অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতপার্থক্য হলে বাংলা কংগ্রেসে ফাটল দেখা দেয়। অজয়বাবুর নেতৃত্বাধীন দল মিশে যায় কংগ্রেসের সঙ্গে। বাংলা কংগ্রেস ভেঙে গেলে সিদ্ধার্থ শংঙ্কর রায়ের প্রেরণায় প্রণববাবু জাতীয় কংগ্রেসে চলে আসেন। কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর আপন প্রজ্ঞা, যুক্তনিষ্ঠ বক্তৃতার দখল দেখিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর সুনজরে আসেন তিনি। ফলে ১৯৬৯ সালের পরে ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৮৭, ১৯৯৩, ১৯৯৯ সালে রাজ্যসভার সাংসদ হন।
ইন্দিরা গাঁধীর মন্ত্রীসভায় ১৯৭৩-৭৪ সালে প্রথম শিল্পোন্নয়ন বিভাগের উপমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন। সাংগঠনিক দক্ষতার জেরে ১৯৭৮-৮০ পর্যন্ত রাজ্যসভার দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে ৩১ অক্টোবর রক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যু হলে রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। কিন্তু রাজীব গাঁধীর সঙ্গে মতপার্থক্য ঘটলে প্রণববাবু কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং রাষ্টীয় সমাজবাদী পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। পরে অবশ্য আবার তিনি ফিরে আসেন কংগ্রেসে।
১৯৯৫-৯৬ সালে নরসীমা রাও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি মন্ত্রীসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট ২০০৪ সালে কেন্দ্রে সরকার গঠন করলে প্রণববাবু প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালে দক্ষতার সঙ্গে সামলিয়েছেন অর্থমন্ত্রীর পদও। অবশেষে ২০১২ সালে পিএন সাংমাকে পরাজিত করে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। অবসান ঘটে তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের। একাধিক পুস্কার সহ গত বছরই তিনি পেয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারতরত্ন’।
বীরভূম জেলার উন্নয়নেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে যথেষ্ট। কীর্নাহার পাশ্ববর্তী জুবুটিয়ার জপেশ্বর মন্দিরের সংষ্কার করেন। জুবুটিয়ার বাসষ্ট্যান্ডে গ্রামের ঢোকার মুখের তোরণ তিনি তাঁর মায়ের নামে উৎসর্গ করেছেন। তাঁরই অনুপ্রেরনায় লাভপুরের ফুল্লরা মন্দির নতুনভাবে সেজে ওঠে। নির্মিত হয় উপাসনা গৃহ, তারাশংকর ভবন ও কামদাকিংঙ্কর ভবন। কীর্নাহার শিবচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে তাঁর একটি সংগ্রহশালাও নির্মিত হয়েছে। পাশাপাশি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির দুর্গাপুজোতে আজও কমবেশি সকল শ্রেণীর মানুষের সমাগম ঘটে। তাঁর প্রয়াণে সমগ্র ভারত সহ বীরভূম গভীরভাবে শোকাহত।
তথ্য ঋণ : শিবশংকর ঘোষ ও গৌরগোপাল পাল