অস্তাচলে বীরভূম জেলার ভ্রমরকোল গ্রামের পট ও পটুয়া (ভিডিও সহ)

Advertisement
বীরভূম জেলার ভ্রমরকোলের পট শিল্প তেমনভাবে কখনও প্রচারের আলোয় আসেনি। এককালে এই গ্রামের প্রায় অনেকেই পট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ক্রমশ পট শিল্পের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় এখন শুধুমাত্র নির্মল পটুয়া-ই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। বাকিরা ছেড়ে দিয়েছেন এই বৃত্তি। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি
%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259A%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%25AC%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AE %25E0%25A6%259C%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B0 %25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258B%25E0%25A6%25B2 %25E0%25A6%2597%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0 %25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%259F %25E0%25A6%2593 %25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%259F%25E0%25A7%2581%25E0%25A7%259F%25E0%25A6%25BE 2
সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল :রাঢ় বাংলার শ্রেষ্ঠ লোকায়ত শিল্পের নিদর্শন হল পট। পটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত রয়েছে পটের গান ও পটুয়া সমাজ। বীরভূম জেলার ষাটপলসা, ইটাগড়িয়া, হাটসেরান্দি, পাকুড়হাঁস প্রভৃতি গ্রামগুলি দীর্ঘদিন ধরেই পটের গ্রাম নামে বিশেষভাবে পরিচিত। তবে এই জেলার ভ্রমরকোল গ্রামের নামও উল্লেখ করার মতো। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রামের কিছু পটুয়া পরিবারও পট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। যদিও তাঁরা তেমনভাবে পরিচিত নন। গ্রামটি বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া ব্লকের অন্তর্গত এবং আমোদপুর শহরের খুব কাছেই অবস্থান করছে। তবে বর্তমানে এই গ্রামের পট শিল্প অনেকটাই বিলুপ্তির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভ্রমরকোলের পটুয়া – ভ্রমরকোল গ্রামটি আমোদপুর শহরের উত্তর পূর্ব কোণে, মূল শহর থেকে ৩ কিমি দূরত্বে অবস্থিত। গ্রামে ১৮টি পাড়ার মধ্যে ‘পটো পাড়া’ অন্যতম। ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পটুয়ারা এই পাড়ায় বসবাস করছেন। কয়েক দশক আগেও এখানে বেশ কিছু পটুয়া পট আঁকা ও পটের গানের সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এখন ২৫টি পটুয়া পরিবারের মধ্যে মাত্র নির্মল পটুয়া-ই পটের গান গেয়ে সংসার চালান। যদিও তিনি পট আঁকতে পারেন না। তবে “গোপালন পট” বা “কপিলামঙ্গল” পটের গান বেঁধে ও তাতে সুর দিয়ে গান গেয়ে যথেষ্ট পারদর্শীকতার পরিচয় দিয়েছেন।
     ভ্রমরকোলে এক সময়ে নামকরা পটুয়া ছিলেন আশু পটুয়া। তিনি আসাধারণ সব পটের ছবি আঁকতে পারতেন। আবার সেই পটের ছবি নিয়ে দূর-দূরান্তে পটের গান গায়তে চলে যেতেন পেটের দায়ে। সাঁওতালি সমাজে পাঁচদিনের বাঁধনা পরবের তৃতীয় দিন অর্থাৎ “খুন্টো”-এর দিনে আগে “গোপালন পট”-এর গাওয়া হত। ভ্রমরকোলের ভুজু পটুয়া, বিপদতারণ পটুয়া, বজ্র পটুয়া প্রায় এক দশক আগেও পটের গান গেয়েছেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে। কিন্তু এখন সেই পেশা ছেড়ে দিয়ে তাঁদেরই কেউ চাষবাস, কেউ রাজমস্ত্রী, কেউ রঙমস্ত্রী আবার কেউ ফেরিওয়লার পেশা বেছে নিয়েছেন।
%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259A%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%25AC%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AE %25E0%25A6%259C%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B0 %25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258B%25E0%25A6%25B2 %25E0%25A6%2597%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0 %25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%259F %25E0%25A6%2593 %25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%259F%25E0%25A7%2581%25E0%25A7%259F%25E0%25A6%25BE
পটের ছবি দেখাচ্ছেন নির্মল পটুয়া
গোপালন পট – বীরভূম জেলার লুপ্তপ্রায় পটের মধ্যে অন্যতম হল “গোপালন পট”। যার অস্তিত্ব শুধুমাত্র এই ভ্রমরকোল গ্রামেই টিকে রয়েছে। একটা সময় ছিল যখন গ্রামের প্রত্যেক পটুয়া দুর-দুরান্তে চলে যেতেন “গোপালন পট” দেখাতে। এখন তার সবই প্রায় অতীত। গোপালন পটের কাহিনীতে দেখা যায়, শাশুড়ি লীলাবতী তার সাত পুত্রবধূকে কপিলা গাভীর পরিচর্চার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু সাত পুত্রবধূ সে কথার অনথা করে। ছোট বৌমা পাঁচ মাসের গর্ভবতী কপিলা গাভীকে ঝাটা পেটা করলে গাভীটি গৃহ ছেড়ে চলে যায়। পরে শাশুড়ি কপিলা গাভীকে ফিরিয়ে এনে ছোট বৌমাকে শাস্তি দিচ্ছেন।
     এছাড়াও এই পটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পটের শেষে যমরাজের উপস্থিতি। কাহিনীর শেষ মুহূর্তে যমরাজ উপস্থিত হয়ে দুষ্টু কর্মকারীকে শাস্তি দেন। ভ্রমরকোলের নির্মল পটুয়া গোপালন পটের শেষে যমপুরীর কথা ও নানা কুকর্মের শাস্তির বিধান গানের মাধ্যমে উল্লেখ করেন। নির্মল পটুয়ার কাছে বহু পুরাতন একটি “যমপট”-এর ছবি আজও অক্ষত রয়েছে।
সমাজ জীবনে পটুয়া ও পটের গান – পটুয়াদের তুলির টানে ফুটে ওঠে গ্রাম্য জীবনের বাস্তব চিত্র। সমাজ জীবনে ধর্মের সংহতি আনতে পটুয়াদের গুরুত্ব অপরিসীম। পটুয়ারা জাতিতে না হিন্দু না মুসলমান। দুই ধর্মের আশ্চর্য মেলবন্ধন রয়েছে তাঁদের মধ্যে। ভ্রমরকোলের পটুয়ারা ঈদের আগে যেমন রোজা রাখেন, ঠিক তেমনি আবার মনসা পুজো বা অন্য সব দেব-দেবীর পুজোও করেন। তাঁদের পটের গানে শিব ও ভগবতীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
     আসলে সমাজে প্রচলিত তথাকথিত ধর্মীয় সংকীর্ণতার বাতাবরণ মুছে ফেলে তাঁরা মানবতার গান রচনা করেন। তাঁদের পটের গানে ফুটে ওঠে চিরাচরিত প্রথা, সংস্কার  উপদেশ, নীতিশিক্ষার অজানা কাহিনী।
     গোপালন পটে নির্মল পটুয়ার গানে উল্লেখ পাওয়া যায়, “সকালবেলায় সরোঝাঁটি, সন্ধেবেলায় বাতি মা, তাহার ঘরে বিরাজ করে লক্ষ্মী ভগবতী।” আবার সমাজে অন্যায় আচরণ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে এবং পরলোকে কর্মফল ভোগ সম্পর্কে সমাজের মানুষকে অবগতও করছেন তারা। তাই পট দেখানোর শেষ পর্বে যমপটের গান দিয়ে নির্মল পটুয়া উল্লেখ করেছেন, “রবির পুত্র যমরাজ আমার, যম নামটি ধরে বিনা অপরাধে মাগো, দন্ড নাহি করে।” তাই বলা যায় সমাজ সংস্কার ও ন্যায় বোধ জাগাতে পটুয়াদের প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখবে। গোপালন পটের প্রভাবে আজও গ্রাম বাংলায় দেখা যায়, ভাদ্র মাসে গোয়ালে মাটি দেওয়া হয় না। গোয়ালে বসে চাল ভাজা বা কলাই ভাজাও খাওয়া হয় না। এটা নিছকই অন্ধবিশ্বাস বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু এর মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে সমাজ সংস্কারের উৎকৃষ্ট প্রতিচ্ছবি।
বর্তমান সম্যসা – নগর সভ্যতার সঙ্গে অভিযোজিত হওয়ার ফলে গ্রাম্য জীবনেও ঘটেছে একাধিক পরিবর্তন। তাই গ্রাম থেকে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে সুপ্রাচীন পট শিল্প। পট শিল্প এখন বেঁচে রয়েছে শুধুমাত্র প্রবীণ পটুয়াদের স্মৃতিকথায়। স্থানীয় প্রশাসন শিল্পীদের প্রতি উদাসীন হওয়ার জন্য ভ্রমরকোলের পটুয়ারা এই পেশা থেকে ক্রমশ মুখ সরিয়ে নিয়েছেন। শিল্প অনুরাগী ও বিদগ্ধজনের অভাব, রুচির পরিবর্তনের ফলে পটুয়াদের কেউ আর আগ্রহও প্রকাশ করছেন না পটের গান শোনাতে। পূর্বে পটের গান ছিল লোকশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল যুগে এই শিল্পের জায়গা দখল করে নিয়েছে অর্ন্তজাল, টিভি, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া। তাই পটুয়ারা এখন উপেক্ষিত। পট দেখিয়ে প্রাপ্য সম্মানটুকুও পান না তাঁরা। এখন তো অনেকেই তাঁদের এই বৃত্তিকে ভিক্ষার সমান বলে মনে করছেন। পটুয়াদের বর্তমান প্রজন্মরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন পটচর্চা থেকে। পেটের দায়ে পট শিল্প ছেড়ে তাঁরা বেছে নিয়েছেন বিকল্প অন্য জীবিকা।
     ভ্রমরকোলের নির্মল পটুয়া, ভুজু পটুয়া, ব্যাপারী পটুয়া-রা জানালেন, আগে গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে একটি করে গরু থাকত। এখন শুধু গোয়ালাদের বাড়িতেই গরু দেখা যায়। তাই গোপালন পটের চল অনেক কমে গিয়েছে। তাঁরা দাবি করছেন, প্রশাসনিক দিক থেকে কোনও অনুদান মিললে অথবা বিভিন্ন সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে পটের গানকে মঞ্চস্থ করার ডাক পেলে তাঁরা আবার তাঁদের পুরনো পেশায় অর্থাৎ পট শিল্পে ফিরে যেতে রাজী রয়েছেন।
     ভ্রমরকোলের পট শিল্পীরা আরও মনে করছেন, বিভিন্ন স্থানীয় ব্লক ও পঞ্চায়েত স্তরে সামাজিক প্রকল্প যেমন- বৃক্ষরোপন কর্মসূচী, কন্যাশ্রী, বাল্যবিবাহ, পালস পোলিও, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বাস্থ্যবিধি, শৌচালয় ব্যবহার প্রভৃতির প্রচারে মানুষকে চিত্র প্রদর্শন ও গানের মাধ্যমে সচেতন করার ব্যবস্থা করলে ঐতিহ্যবাহী এই পট শিল্প হয়তো আরও কিছুদিন গ্রাম্য সমাজের বুকে টিকিয়ে রাখা যাবে।
Advertisement
Previous articleনওয়া গ্রামে পালিত হল ১৬৬তম হুল দিবস
Next articleএবার ভিনগ্রহী খুঁজতে ব্যবহার করা হবে লেসার রশ্মি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here