যক্ষ্মা রোগীদের অন্যতম নিরাপদ আশ্রয় ছিল বীরভূমের ‘নিরাময় টিবি স্যানিটোরিয়ম’

Advertisement
সেসময়ে যক্ষ্মা রোগীদের জন্য ছিল না কোনও ভালো হাসপাতাল ও ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা। যক্ষ্মাকে পাপের ফল হিসাবেও অনেকে চিহ্নিত করত। এই রোগীদের পুরোপুরি সুস্থ করে তোলার পথ দেখাতে এগিয়ে এলেন ডাঃ গুণেন্দ্রনারায়ণ রায়। তিনিই প্রথম উদ্যোগ নিয়ে বীরভূম জেলার হেতমপুরে গড়ে তুললেন যক্ষ্মা চিকিৎসাকেন্দ্র ‘নিরাময় টিবি স্যানিটোরিয়ম’ – ছবি : লেখক

বাংলার যক্ষ্মা রোগীদের নিরাপদ আশ্রয় ছিল বীরভূমের ‘নিরাময় টিবি স্যানিটোরিয়ম’
সৈয়দ মৈনুদ্দিন হোসেন (অশোক) : বিংশ শতাব্দীর ৪০-৫০-এর দশকে যক্ষ্মা বাংলার সাথে সাথে বীরভূমেও শিকড় ছড়িয়েছিল। এই রোগটিকে তখন বলা হত ‘রাজরোগ’। এই রোগ গ্রামের মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যেত। অর্থনৈতিক কারণে ঠিকঠাক পুষ্টিকর খাবার না পাওয়া এবং অসচেতনতার জন্যই এর প্রাদুর্ভাব বেশি হত। মানুষের কুসংস্কার ছিল, কুষ্ঠ রোগের সাথে সাথে যক্ষ্মাও হচ্ছে পাপের ফল। তাই মানুষ এই রোগ হলে গোপন করে যেত আর বিনা চিকিৎসায় মারা যেত। তখন এই এলাকায় সেভাবে কোথাও এই রোগের চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল না।
     ১৯৫৪ সাল। লালগোলার রাজবংশের বিশিষ্ট সমাজসেবী ডাঃ গুণেন্দ্রনারায়ণ রায়। যে বংশের মানুষেরা শুধু স্বাস্থ্যসেবার জন্যই চিরকাল থেকে যাবেন বাঙালির হৃদয়ে। এই বংশের রাজা জেএন রাও বহরমপুরে হাসপাতালের জন্য জায়গা এবং প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন। সেই হাসপাতাল আজও জেএন রাও হাসপাতাল নামেই পরিচিত। কলকাতায় তাঁদের প্রতিষ্ঠিত নিরাময় ছিল সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা। তো সেই রাজবংশের বাবু গুণেন্দ্রনারাণ রায় ১৯৫৪ সালে আসেন বীরভূম জেলার হেতমপুর এলাকায়। উদ্দেশ্য নিরাময় নামে একটি টিবি স্যানিটোরিয়ম প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর ভাই বাবু বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের বিয়ে হয়েছে হেতমপুর রাজবংশের বাবু রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তীর কন্যার সঙ্গে। ভাইও বিশিষ্ট মানুষ। তিনি দীর্ঘদিন নবগ্রাম বিধানসভার বিধায়ক ছিলেন।
     ডাঃ রায় হেতমপুর রাজপরিবারের কাছে হাসপাতালের জন্য জমি চাইলেন। হেতমপুর রাজপরিবারও একটি যক্ষ্মা রোগের হাসপাতাল করার কথা ভাবছিলেন। কারণ তার কয়েক বছর আগেই রাজপুরুষ বাবু বিশ্বরঞ্জন চক্রবর্তী এই যক্ষ্মা রোগেই দেহ রেখেছেন। রাজপরিবারের সকলে মিলে জায়গা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মহারাজা রামরঞ্জন ট্রাস্টির জায়গা ছিল পাশেই গিরিডাঙ্গায়। এই সেই গিরিডাঙ্গা, যেখানে ছিল হেতমপুর রাজাদের বাগানবাড়ি। জামাইয়ের বড় দাদার অনুরোধে রাজমাতা প্রতিভাসুন্দরী দেবী, বৌরাণী জ্যোৎস্নাময়ী দেবী এবং বাবু শচীন্দ্র মোহন রায় গিরিডাঙ্গার ১৬৮ একর (মতান্তরে ২৫০ বিঘা) সম্পত্তি স্যানিটোরিয়মের জন্য দান করে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে কিছু ধানের জমিও ছিল।
     ডাঃ গুণেন্দ্রনারায়ণ রায় কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের কিছু টাকা গ্রান্ট হিসাবে পেয়েছিলেন। নিজস্ব টাকা আর কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রান্ট মিলিয়ে তিনি পুণ্যবতী রাজমাতা প্রতিভাসুন্দরী দেবী, বাবু শচীন্দ্র মোহন রায় আর পুণ্যবতী বৌরাণী জ্যোৎস্নাময়ী দেবীর দানকরা জায়গায় শুরু করলেন স্যানিটোরিয়ম তৈরির কাজ।
     ১৯৫৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর এল সেই সুদিন। সেই দিনই উদ্বোধন হল নিরাময় টিবি স্যানিটোরিয়মের। মাত্র ১০টি শয্যা সংখ্যা নিয়ে পথ চলা শুরু। উদ্বোধনের দিনে এলাকার বিশিষ্ট মানুষেরাও এসেছিলেন নিরাময়ে। হেতমপুর রাজবংশের বাবু মাধবীরঞ্জন চক্রবর্তী ছিলেন প্রধান অতিথি। উদ্বোধনী সংগীত গেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্র-ছাত্রীরা। ‘মোদের যাত্রা হলো শুরু’, এই গান দিয়ে শুরু হয়েছিল সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। তারপর শুধুই উন্নতি। নিরাময় তখন শুধু দুবরাজপুর এলাকার নয়, শুধু বীরভূমের নয়, সারা বাংলা আর বিহারের এক নিরাপদ আশ্রয়। দলে দলে যক্ষ্মা রোগীরা আসেন আবার সম্পূর্ণ রোগ নিরাময় হয়ে ফিরে যান নিজগৃহে। রোগীদের সাথে সবসময় আছেন ডাঃ গুণেন্দ্রনারায়ণ রায়। যক্ষ্মাও যে চিকিৎসায় সেরে যায়, সে বিশ্বাস মানুষের মধ্যে আনতে পেরেছিলেন ডাঃ গুণেন্দ্রনারায়ণ রায় আর তাঁর স্বপ্নের নিরাময়।
     দুবরাজপুরের নিরাময়ের কথা পৌঁছে যায় স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কানে। তিনি আবারও টাকা গ্রান্ট করেন আরও শয্যা বাড়ানোর জন্য। আরও দুটি ওয়ার্ড বেড়ে যায়। শয্যা সংখ্যা বেড়ে হয় পঞ্চাশ। সালটা ১৯৫৯। সেই ওয়ার্ডের উদ্বোধন করতে ব্যস্ত নেহেরুজি আসতে না পারলেও পাঠিয়েছিলেন তাঁর মন্ত্রীসভার উদ্বাস্তু পুনর্বাসন মন্ত্রী মেহেরচাঁদ খান্না-কে। মেহেরচাঁদ খান্না ডাঃ গুণেন্দ্রনারায়ণ রায়-কে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্ট হয়ে আরও অনুদান দেবার কথা বলেছেন। সেদিনের সেই বিল্ডিং-এর গায়ে আজও শ্বেত পাথরের উপর লেখাটি সেদিনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। সেখানে লেখা রয়েছে “ENDOWED BY SRI JAWAHARLAL NEHRU. Prime minister of India. 1959.”।
বাংলার যক্ষ্মা রোগীদের নিরাপদ আশ্রয় ছিল বীরভূমের ‘নিরাময় টিবি স্যানিটোরিয়ম’
     সেই পঞ্চাশটি শয্যা শেষে তিনশো শয্যা হয়। সাহায্য বাড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের, গ্রান্ট দিতে শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়। ডাঃ রায় খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন ডাঃ গুণেন্দ্রনারায়ণ রায়ের কাজে। তবে সরকারি সাহায্য থাকলেও সরকার তখন তা অধিগ্রহণ করেনি। সব দায়িত্ব বিনাবেতনের সেক্রেটারি ডাঃ গুণেন্দ্রনারায়ণ রায়ের। কী অসম্ভব দক্ষতার সাথে সমস্ত দায়িত্ব সামলাতেন ডাঃ রায়। কত ভালো ভালো ডাক্তার নিয়োগ করেছিলেন তিনি। সব ধন্বন্তরী ডাক্তার। ডাঃ পিসি চৌধুরী প্রথম ডাক্তার। তিনি ইনচার্জও। তারপর ডাঃ মল্লিক, ডাঃ এনকে সাহা, ডাঃ এনসি সাহা, ডাঃ এজি ঘোষ, ডাঃ এসএন ঘোষের মতো স্বনামধন্য ডাক্তাররা ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে। এইসব ডাক্তারদের দেখলেই রোগীর যক্ষ্মা অর্ধেক ভালো হয়ে যেত।
     রোগীদের খাওয়াদাওয়ার দিকেও তীক্ষ্ণ নজর ছিল ডাঃ রায়ের। ব্যবস্থা ছিল মাছ, মাংস, ডিমের। প্রতিদিন আমিষ থাকতেই হবে খাদ্য তালিকায়। টিফিনে থাকত ডিম, ফল, পাঁউরুটি। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা আর খাওয়া সবই ছিল বিনামূল্যে। ডাঃ রায় রোগীদের খাওয়ানোর জন্য একটি বেকারি ও একটি পোলট্রি ফার্ম করেছিলেন। বেকারি নিরাময়ের হলেও এর সব দায়িত্ব ছিল ইরফান আলীর। ইরফান আলী কোথাকার মানুষ ছিলেন, তা আর জানা যায় না। নিয়ম অনুযায়ী, স্থানীয় বাসিন্দারা এই রুটি ক্রয় করতে পারতেন। তবে শর্ত ছিল, যদি সেই পরিবারের কোনও সদস্য জ্বর বা অন্য কোনও রোগে অসুস্থ থাকেন, তবেই তার জন্য পাঁউরুটি পাওয়া যাবে। যেহেতু বাইরের লোকজনকে পয়সা দিয়ে কিনতে হত। তাই তেমন কড়াকড়ি ছিল না। একজন রোগীর নাম বললেই হত, প্রমাণ দেখাতে হত না। ইরফান আলীর এই পাঁউরুটিতে সুন্দর একটা সুগন্ধ ছিল আর ছিল অসাধারণ স্বাদ। তার বর্ণনা দেওয়া কঠিন। এমনকি হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত করাচী বেকারির পাঁউরুটিও এর কাছে হার মেনে যায়।
     দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ যক্ষ্মা নিয়ে এখানে আসেন আর ডাক্তার এবং নার্সদের সেবায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা আবার নতুন রোগীর সেবায় নিয়োজিত হয়ে যান। সেদিকেও নজর এড়িয়ে যায়নি ডাঃ গুণেন্দ্রনারায়ণ রায়ের। তিনি সকলকে নিয়ে তৈরি করেন নিরাময় স্টাফ রিক্রিয়েশন ক্লাব। সেদিনের এই স্টাফ রিক্রিয়েশন ক্লাবও সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং খেলাধূলার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিল। তাঁরা নিজেরা যেমন ফুটবল খেলতেন, তেমনি টুর্নামেন্টের ব্যাবস্থা করতেন। সেই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করত পছিয়াড়া, দুবরাজপুর, হেতমপুর, যশপুর, বোদাকুড়ি, কানতোড়, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি পাশাপাশি গ্রামগুলি। ক্লাবের পক্ষ থেকে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ পেত।
     এই ক্লাব দুর্গাপুজোরও আয়োজন করত খুব ধুমধাম করে। সে পুজো আজও বন্ধ হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা এখন এই পুজোর আয়োজন করেন। হেতমপুরের রাজপ্রাসাদের দুর্গাপুজো এবং অন্যান্য পুজোগুলি রাজকন্যা বৈশাখি চক্রবর্তী ও তাঁর দিদি অনুরাধা চক্রবর্ত্তী এখনও চালু রেখেছেন।
     ১৯৬০ সাল থেকে ক্লাবের নাট্যচর্চাও ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঘোষের পরিচালনায় কালিন্দী, চক্র, ভাড়াটে চাই, বারোভূতে এই ক্লাবের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। ডাঃ এনকে সাহা, জয়ন্তী ভট্টাচার্য, বিপদভঞ্জন মণ্ডল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঘোষ, বিশিষ্ট ছড়াকার আশানন্দন চট্টরাজ সহ বিশিষ্ট মানুষেরা অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কালিন্দী নাটকে সিউড়ি বেনেপুকুর পাড়ার মানিক কাহারের আলোক সম্পাত আজও এলাকার বয়স্কদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।
     এখানে যক্ষ্মা রোগীদের ধর্মীয় ব্যপারটিও ডাঃ রায়ের নজর এড়িয়ে যায়নি। নিরাকারে বিশ্বাসী ধর্মপ্রাণ মুসলিম রোগীরা ছায়াঘেরা আমগাছের বা বড়গাছের সুশীতল ছায়ায় অথবা বিশাল বিল্ডিংয়ের নিচে তাঁদের নামাজ আদায় করে নিতে পারতেন। কিন্তু ধর্মপ্রাণ হিন্দু রোগীদের জন্য একটি ছোট্ট মন্দিরের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। চিকিৎসার সাথে সাথে একটি বিশেষ আশ্রয়ের দরকার সাধারণ রুগীদের, সেই আশ্রয় রুগীরা পায় আল্লাহ বা ভগবানের কাছে। তাই শাঁখের আওয়াজ, মন্দিরের ঘন্টাধ্বনিরও প্রয়োজন ধর্মবিশ্বাসী মানুষের। সেই ভাবনা থেকেই ডাঃ রায় হাসপাতাল চত্বরের অদূরে রাস্তার ওপারে একটি সুন্দর শিবমন্দির তৈরি করেন। আর সেই মন্দিরের পূজার্চনা শুরুর দিনে নিয়ে আসেন বেনারসের আনন্দময়ী মা-কে। সেদিক দিয়ে দেখলে নিরাময় আনন্দময়ী মায়ের চরণ ধন্যও বটে।
     তারপর ১৯৮২ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার স্যানিটোরিয়মটি অধিগ্রহণ করে। দিনটি ছিল ২৭ আগস্ট। সময় এগিয়ে গেছে। আধুনিক পদ্ধতিতে DOTS Programme-এর মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা চালু হয়েছে। জেলায় প্রায় একশোটা DOTS Centre চালু হয়েছে। রোগ সারাবার জন্য আর রোগীকে হাসপাতালে থাকতে হয় না। ফলে ২০১০ সাল থেকে নিরাময়ের অভ্যন্তরীন বিভাগ (Indoor) বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বহির্বিভাগটি (outdoor) চালু আছে। এই বিশাল স্যানিটোরিয়মটি এখন একদম ফাঁকা।
Advertisement
Previous articleরক্তের ঘাটতি মেটাতে রক্তদান শিবিরের আয়োজন ভুবনডাঙায়
Next articleব্রহ্মাণ্ডে খোঁজ পাওয়ার পথে ৩৬টি উন্নত ভিনগ্রহী সভ্যতার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here