‘ওউমুয়ামুয়া’ কি এলিয়েনদের মহাকাশযান, নাকি অন্য কিছু !!

Advertisement
২০১৭ সালের অক্টোবরে সৌরজগতের বাইরে থেকে আসা ‘ওউমুয়ামুয়া’ পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নজরে আসে। তারপর থেকেই তাকে নিয়ে গবেষণা ও আলোচনার শেষ নেই। অনেকে এটিকে এলিয়েন-দের কোনও মহাকাশযানের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। চলমান এই অজ্ঞাত বস্তুটি ২০২২ সাল নাগাদ নেপচুনকে অতিক্রম করে গভীর মহাশূন্যে হারিয়ে যাবে। – ছবি : সংগৃহীত

‘ওউমুয়ামুয়া’ কি এলিয়েনদের মহাকাশযান
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় :বেশ কিছুদিন থেকে ‘ওউমুয়ামুয়া’-কে নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছিল। নির্ণয় করা যাচ্ছিল না তার প্রকৃত পরিচয়। ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ওউমুয়ামুয়া সৌরজগতে প্রবেশ করার পর তাকে চিহ্নিত করেন বিজ্ঞানীরা। এমন আশ্চর্য মহাজাগতিক বস্তুর খোঁজ আগে পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা তাই নানা সংশয়ে ছিলেন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল, বস্তুটি হয়তো একটি ধুমকেতু। কেউ কেউ এটিকে বড় ধরনের উল্কা বলেও সাব্যস্ত করেন। কিন্তু কোনও কিছুই ঠিকঠাক মিল ছিল না। হাওয়াইয়ান অ্যাস্ট্রোনমারা নিরন্তর পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন মহাজগতিক বস্তুটিকে। প্রায় ১০০০ ফুট লম্বা সিগারের মতো লালচে কালো কঠিন বস্তুটিকে প্রথমে ধুমকেতু বলেই সন্দেহ করা হয়েছিল।
     হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী রবার্ট ওয়েরিক যখন নিরীক্ষণ করছিলেন মহাজাগতিক বস্তুটিকে, তখন তার গতিবেগ ছিল ২৬ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড। অনেকেই দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে ধারণা করেন ওয়ান-আই/২০১৭ইউওয়ান (1-I/2017U1) নামক মহাজাগতিক বস্তুটি আসলে এলিয়েনদের প্রেরিত উন্নত মানের মহাকাশযান। সেই অনুসারে বস্তুটির নামকরণও করা হয় ওউমুয়ামুয়া, যার অর্থ হল দূত বা বার্তাবাহক। বিজ্ঞানী মহলে খুব বড় রকম হইচই পড়ে যায়। সেরকম হলে যানটি থেকে কোনওরকম বেতার তরঙ্গ বেরিয়ে আসার কথা। সতর্কভাবে পরীক্ষা করা হতে থাকে যানটি থেকে কোনও তরঙ্গ বেরিয়ে আসছে কিনা। কিন্তু বহু পরীক্ষাতেও বেতার বা অন্য কোনও তরঙ্গ বেরিয়ে আসার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
     রহস্য আরও ঘনীভূত হয় যখন এই মহাজাগতিক বস্তুটি সূর্যের সবচেয়ে নিকটে আসে। তখন পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব ছিল পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের ৮৫ গুণ। যদি ওউমুয়ামুয়া কোনও ধুমকেতু হতো তাহলে তার লেজের অংশ সূর্যের নিকটে এসে আয়নিত হয়ে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করত। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এই রকম কোনও উজ্জ্বল ছটা ওউমুয়ামুয়া থেকে বিচ্ছুরিত হল না। তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় এই যে সূর্যের কাছে আসার পর তার গতিবেগ অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেল। সেই সময় তার গতিবেগ হয়েছিল ৪০ মাইল প্রতি সেকেন্ড। এরকম গতির পরিবর্তন কোনও ধুমকেতু, বড় গ্রহাণু বা উল্কার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় না। গতির বিষয়টি থেকেই অনেকে নিশ্চিত হয়ে যান এটি নিশ্চয়ই অন্য কোনও নক্ষত্রমণ্ডলী থেকে আগত এলিয়েনদের মহাকাশযান, যারা পৃথিবীর জীবজগৎ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য এই যান পাঠিয়েছে।
     অনেকেই মনে করতে থাকেন এটি নিশ্চয়ই লাইট সেল। কিন্তু লাইট সেল হলে সোজাসুজি যাওয়ার কথা। কিন্তু এই মহাজাগতিক বস্তুটির ভয়ঙ্কর রকম উপবৃত্তাকার পথে বিচরণশীল। তার ওপর এটি প্রায় ডিগবাজি দেওয়ার মতো করে ঘুরপাক খেতে খেতে দ্রুত গতিতে চলেছে। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন এটি আমাদের সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার মতো গ্রহ মন্ডলের কোনও বস্তু নয়। এ সূর্যের আকর্ষণ ছাড়িয়ে অনায়াসে চলে যাবে গভীর মহাশূন্যে (ডিপ স্পেস)। সবচেয়ে আশ্চর্য, এর বিরাট (১.২) প্যারাবোলিক কক্ষপথ। যে পথ চলে গেছে বৃহস্পতি এবং নেপচুনের কক্ষপথের মাঝখান দিয়ে। সমস্ত দিক পর্যালোচনা করে অনেকেই নিশ্চিত হন এটা হল আর্থার সি ক্লার্কের বিখ্যাত উপন্যাস ‘Rendezvous With Rama’-তে বর্ণিত সেই বিরাট স্পেসশিপ।
‘ওউমুয়ামুয়া’ কি এলিয়েনদের মহাকাশযান
‘ওউমুয়ামুয়া’-র গতিপথ 
     কিন্তু ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বিজ্ঞানী Dr. Darryl Seligman নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন প্রকৃত সত্য উদ্ভাবনের জন্য। তাদের অভিমত ওই সিগারের মতো লম্বা কঠিন বস্তুটি হল একটি মহাজাগতিক ‘আইসবাগ’। যা চরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছিতে ঘনীভূত হাইড্রোজেন ও মহাজাগতিক ধূলিকণার অবশেষ দ্বারা নির্মিত। এই বৃহৎ মহাজাগতিক আইসবাগটির কাঠিন্য পাথরের চেয়ে অনেক বেশি। এটি সৃষ্টি হয়েছে ছায়াপথগুলির একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত ঘন ঠান্ডা অন্ধকারময় মহাজাগতিক মেঘপুঞ্জ থেকে। যে অন্ধকারময় জগতে কোনও সূর্য নেই, তাপমাত্রা যেখানে চরম শূন্যের কাছাকাছি। যেখান থেকে তাপমাত্রার কোনও বিচ্ছুরণ হয় না। সেখানকার মেঘপুঞ্জ তৈরি হয়েছে সার্কুলার হাইড্রোজেন দিয়ে। যা ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিতে ‘বিগ ব্যাং’-এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের অভিমত এটা সেই অঞ্চল থেকে এসেছে যেখান থেকে এখনও ব্রহ্মাণ্ডের নক্ষত্রগুলির জন্ম হয়। সেই দূরতম প্রান্তে পৌঁছন এখনও মানব প্রযুক্তির পক্ষে কোনওভাবেই সম্ভব নয়।
     বাস্তবিক ওউমুয়ামুয়া হল সৃষ্টির আদিকালে সৃষ্টি হওয়া হাইড্রোজেন মেঘপুঞ্জের বরফে ঘনীভূত আইসবাগ। যেহেতু তা অনেক দূর দিয়ে, অত্যন্ত দ্রুত মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, তাই তাকে নিয়ে আর বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ নাই। কারণ ২০২২ সাল নাগাদ ওউমুয়ামুয়া নেপচুনকে অতিক্রম করে গভীর মহাশূন্যে পাড়ি জমাবে। এই মহাজাগতিক বৃহৎ হাইড্রোজেন নির্মিত বরফের কিউবটিকে যদি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হতো, তবে সৃষ্টির আদ্যিকাল এবং ছায়াপথের দূরতম প্রান্তে অন্ধকারময় জগতে অবস্থিত তারাদের সূতিকাগার বিষয়ে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হতো।
     কিন্তু ওউমুয়ামুয়া যে সুদূরের আহ্বান জানিয়ে গেল তা ব্যর্থ হবার নয়। অধ্যাপক Seligman জানিয়েছেন, তিনি ও তার সহযোগীরা যদি ওউমুয়ামুয়ার প্রকৃতি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে থাকেন তবে ভবিষ্যতে আবারও এই ধরনের আইসবাগ পর্যবেক্ষণের সুযোগ মিলবে। যদিও এই বিরাট মহাকাশে এই ধরনের ছোট্ট কোনও বস্তুকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন কাজ। ওউমুয়ামুয়া সূর্যের নিকটে আসায় তার উপরিভাগের হাইড্রোজেন দ্রুত উদ্বায়ু হতে থাকে। তার ফলেই সে অস্বাভাবিক গতি লাভ করে এবং কিছুটা আলোক তা থেকে প্রতিফলিত হয়, তাই তাকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল। তবে চিলির Vera Rubin মানমন্দিরের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সদা জাগ্রত আছেন এই ধরনের বহির্জাগতিক বস্তুর অনুসন্ধানে। তাছাড়া ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি সম্প্রতি একটি প্রজেক্ট তৈরি করেছে ধুমকেতু, এলিয়েন স্পেসশিপ বা মহাজাগতিক বস্তুপিন্ড পর্যবেক্ষণের জন্য। পৃথিবীর কাছে মহাশূন্যে অবস্থান করবে একটি স্পেস সাটেল। এই ধরণের ভ্রাম্যমান কোনও অস্বাভাবিক বস্তু দেখতে পেলেই সে তার পেছনে ধাওয়া করবে। বর্তমানে সেই সুদূর পথের পথিকদের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
Advertisement
Previous articleকরোনায় আক্রান্তদের ঘ্রাণশক্তি কমে যায়, কিন্তু কেন?
Next article‘গ্রহণ’ চলাকালে খাওয়া চলবে না, ব্যাপারটি একেবারেই গ্রাহ্য নয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here