Advertisement
পরিবেশে উইপোকা না থাকলে পৃথিবীর অধিকাংশ মৃত গাছ সারা জীবনই শুকনো কাঠ হয়ে পড়ে থাকতো। তাদের নষ্ট করা যেত না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশবিদরা উইদের ‘পরিবেশের এক ক্ষুদ্র সংস্কারক’ বলেছেন। উই পৃথিবীর একমাত্র পতঙ্গ, যারা গাছের শুকনো কাঠ খেয়ে হজম করতে পারে। – ছবি : সংগৃহীত
|
সজয় পাল : ভাবলে অবাক হতে হয়, প্রতি বছর উইপোকার হাতে সারা পৃথিবীর প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার মূল্যবান সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও পরিবেশবিদদের একাংশের দাবী উইপোকারা নাকি ‘পরিবেশের এক ক্ষুদ্র সংস্কারক’। উইদের শারীরিক গঠন এবং পারিবারিক স্বভাব লক্ষ্য করে দীর্ঘদিন জীব বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল তারা পিঁপড়ে সম্প্রদায় থেকে আবির্ভূত। হয়তো তাই তাদের ইংরেজি নামও দেওয়া হয়েছিল “হোয়াইট অ্যান্ট”। কিন্তু বর্তমান গবেষণায় জানা যাচ্ছে, উইরা আসলে আরশোলা জাতীয় প্রাণী থেকে এসেছে। ফসিলস্ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, প্রায় দশ কোটি বছর আগে এক শ্রেণীর গেছো আরশোলা থেকে উইদের জন্ম।
তা স্বত্বেও পারিবারিক রক্ষণশীলতার ক্ষেত্রে পিঁপড়েদের সঙ্গে উঁইদের আশ্চর্য মিল। পিঁপড়েদের মতই উই পরিবারের সমস্ত সদস্য নিজের প্রয়োজনীয় কাজ নিজেরাই ভাগ করে নেয়। মৌমাছি বা পিঁপড়ের সমাজে যেমন স্ত্রীদের গুরুত্ব বেশি, এই যেমন বাসা বাঁধা, রক্ষনা-বেক্ষন, খাদ্য সংগ্রহ, রানী বা রাজার সেবা করা, বহিরাগত যে কোনও আক্রমণ থেকে নিজের পরিবারকে রক্ষা করা, এরকম সমস্ত কাজই স্ত্রী মৌমাছি বা পিঁপড়েদের করতে হয়। উই পরিবারে অবশ্য স্ত্রী-পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হয়। এরা-ই পৃথিবীর একমাত্র পতঙ্গ, যাদের কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও বিরাম নেই। তারা দিনরাতের চব্বিশ ঘণ্টা-ই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসে।
একটা উঁই পরিবারে চার ধরনের সদস্য থাকে। রানী, রাজা, শ্রমিক, সৈনিক। পরিবার সাধারণত রানীকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়। একটি উই কলোনিতে সাধারণত একটিই রানী উই থাকে (কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে)। গায়ের রঙ কালচে বাদামি। রানী আকারে অন্য সদস্যদের থেকে অনেকটাই বড়, প্রায় ১০ থেকে ২৬ মি.মি.। তার কাজ মূলত ডিম পাড়া। প্রজাতি ভেদে একজন রানী প্রতিদিন গড়ে ১০০টি থেকে ১,০০০টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। রানীর গড় আয়ুও অন্য সদস্যদের থেকে অনেকটাই বেশি, প্রায় ২৫ বছর বা কোনও কোনও প্রাজাতির তার থেকেও বেশি। উই পরিবারে রানীর সংখ্যা একটি হলেও রাজা থাকে ৪-৫টি। এদের গায়ের রঙও রানীর মতই কালচে বাদামি। রাজার আকার রানীর থেকে সামান্য ছোটো হয়।
উই পরিবারে শ্রমিকের সংখ্যা সব থেকে বেশি।কলোনির প্রায় ৯০-৯২ শতাংশই শ্রমিক উই। একটা বড়-সড় উই কলোনিতে প্রায় ১০-১৫ লক্ষ শ্রমিক উই থাকতে পারে। কিন্তু এরা জন্মান্ধ। চোখে কিছুই দেখতে পায় না। তাই বলে কাজের কোনও বিরাম নেই। পরিবারের সমস্ত কাজই দিনরাত এক করে তাদেরকেই করতে হয়। যদিও এরা আকারে যথেষ্ট ছোটো, ৩-১৫ মি.মি.। গড় আয়ু ১০ মাস থেকে ২৪ মাস। এদের গায়ের রঙ সাদা। আর আছে সৈনিক। সমস্ত উই কলোনিকে অতন্দ্র পাহারায় রেখেছে সর্বক্ষণ। কোথাও একটু বিপদের আভাস পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সেখানে। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েও পরিবারকে রক্ষা করে তারা। এদের মাথার সামনের দিকে খুব ছোট্ট ছোট্ট দুটি ছুরির মত অঙ্গ থাকে। যা দিয়ে তারা শত্রুর হাত থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচাতে পারে। এরা আকারে শ্রমিকের থেকে একটু বড় হয়, ৫-২০ মি.মি.। গায়ের রঙ হলদে সাদা, যা শ্রমিক আর সৈনিককে পৃথকভাবে চিনতে সাহায্য করে। গড় আয়ু প্রায় ২৩ মাস থেকে ৪ বছর।
উইদের চিরশত্রু হল পিঁপড়ে। মাঝে মধ্যেই পিঁপড়ে সম্প্রদায় উই কলোনিতে হামলা চালায়। লড়াই বাধে মূলত খাদ্য নিয়ে। তবে এক্ষেত্রে খাদ্য স্বয়ং উই, আর খাদক পিঁপড়ে। যুদ্ধে প্রতিবারই শক্তিশালী পিঁপড়েরা বিজয়ী হয়। তাদের সেনার হাতে অসংখ্য উইয়ের মৃত্যু হয়। যুদ্ধ শেষে পিঁপড়ের দল অসংখ্য মৃত উই মুখে করে পরমানন্দে তাদের বাসায় ফিরে যায়। আর দুর্বল অন্ধ উইয়েরা আবার পরম যত্নে ভাঙা বাসা মেরামত করতে শুরু করে।
এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩২০০ প্রজাতির উইপোকার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। প্রজাতিগতভাবে উইদের ৭টি পরিবারে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- টার্মপ্সিডাই, রাইনোটারমিটিডাই, টারমিটিডাই, ম্যাসটোটারমিটিডাই, ক্যালোটারমিটিডাই, হোডোটারমিটিডাই ও সেরিটারমিটিডাই। বাসস্থানের প্রকৃতি অনুযায়ীও আবার উইদের কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ কার হয়েছে, যেমন- ড্রাইউড, ড্যাম্পউড, সাবটেরানিয়ান, ফরমোসন, কনহেড প্রভৃতি।
শুকনো কাঠ কারও খাদ্য হতে পারে, এটা ভাবাটাই আশ্চর্যের! পৃথিবীতে উইপোকা ছাড়া এমন কোনও প্রাণী নেই যারা শুকনো কাঠ খেয়ে হজম করতে পারে এবং এভাবেই বংশ পরম্পরায় বছরের পর বছর জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু কিভাবে?
আসলে গাছ বা কাঠের মধ্যে সেলুলোজ থাকে। সুগার মলিকিউলগুলি একে অপরের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে সেলুলোজ তৈরি হয়, যা ভাঙা প্রায় অসম্ভবই। তাই কোনও প্রাণীই এই সেলুলোজ হজম করতে পারে না। একধরণের প্রোটোজোয়া উইদের পরিপাকতন্ত্রে আশ্রয় ও খাদ্যের জন্য বাসা বাঁধে। পরিপাকের সময় তারা নিজেদের শরীর থেকে এ্যাসিটিক অ্যাসিডের সাথে আরও অন্য সব অ্যাসিড নিঃসৃত করে, যা সেলুলোজকে সাধারণ শর্করায় ভেঙে দেয়। তখন সেলুলোজ হজমের সহায়ক হয়ে ওঠে। এতে প্রোটোজোয়া এবং উইপোকা উভয়ই বেঁচে থাকতে পারে।
এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, পরিবেশে উইপোকা না থাকলে পৃথিবীর অধিকাংশ মৃত গাছ সারা জীবনই শুকনো কাঠ হয়ে পড়ে থাকতো। তাদের নষ্ট করা যেত না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশবিদরা উইদের ‘পরিবেশের এক ক্ষুদ্র সংস্কারক’ বলেছেন।
বর্ষাকালে মাঝে মধ্যে উইপোকা উড়তে দেখা যায়। এটা আসলে ওদের জনুক্রম, বা খুব ভাল করে বললে নিজের পরিবারকে পরিবেশের সুবৃহৎ অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা পন্থা মাত্র। লার্ভা থেকে নতুন উইপোকার জন্ম হওয়ার সময় শ্রমিক আর সৈনিক শ্রেণীর উই ছাড়াও আর এক নতুন শ্রেণীর উই-এর উদ্ভব ঘটে। এদের মধ্যে পুরুষ এবং স্ত্রী উভয়ই থাকে। গ্রীষ্মের পর নতুন বর্ষার আগমনে মাটির অভ্যন্তরেই এই শ্রেণীর উই-এর ডানা গজিয়ে যায়। এদেরকে ‘অ্যালাট’ বলে। সন্ধ্যার পর তারা মাটির ফাঁক গলে বাইরে বেরিয়ে এসে উড়তে শুরু করে। তারপর তাদের ডানা খসে গেলে স্ত্রী-পুরুষ মিলে জোট বাঁধে। এই অবস্থায় তাদের ‘ডি-অ্যালাট বলে’। সবশেষে তারা অন্যত্র নতুন উই কলোনি তৈরি করে নিজের পরিবার গড়ে তোলে।
এভাবেই নিজেদের বংশকে তারা নিখুঁত গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে নিঃশব্দে। ভাবলে অবাক হতে হয়, একই পরিবার এই পন্থায় প্রায় ৫০-১২০ বছর নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। অন্য কোনও পতঙ্গের পরিবার এভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখার কথা ভাবতেই পারে না।
সূত্র-
১. অর্কিন (Orkin) অনলাইন পেজ
২. রেন্টোকিল পিসিআই (Rentokil PCI) অনলাইন পেজ
৩. এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা
Advertisement